নড়াইলে মজুরি বৈষম্যের শিকার ১৫ হাজার নারী কৃষি শ্রমিক

নড়াইলে মজুরি বৈষম্যের শিকার অন্তত ১৫ হাজার নারী কৃষি শ্রমিক।

নড়াইলে মজুরি বৈষম্যের শিকার অন্তত ১৫ হাজার নারী কৃষি শ্রমিক। পুরুষের সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরি পাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। এ বেতন বৈষম্যের  বিষয়টি নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এ নিয়ে নারী শ্রমিকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, একই জমিতে সমশ্রম দিলেও তাদের পুরুষের তুলনায় মজুরি দেয়া হয় কোথাও অর্ধেক আবার কোথাও তিন ভাগের এক ভাগ। নারী-পুরুষভেদে সবাইকে সমান মজুরি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন জেলার নারী কৃষি শ্রমিকরা। 

নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে কৃষিকাজে শ্রম বিক্রি করেন নড়াইলের নারী শ্রমিকরা। জেলায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত ১৫ হাজার। পুরুষের সঙ্গে বিলে-মাঠে সব ধরনের কৃষিকাজ করেন নারীরা। জেলার তিনটি উপজেলায় নারী শ্রমিক থাকলেও নড়াইল সদরে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। বিশেষ করে নড়াইল সদরের মুলিয়া, তুলারামপুর ও শেখহাটি ইউনিয়নে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শ্রমিক রয়েছেন। ধান রোপণ করা, ধান-পাট কাটা, খেত থেকে আগাছা পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে পুরুষের পাশাপাশি সব ধরনের কাজই নারী শ্রমিকরা সমানভাবে করেন।

সরজমিনে দেখা গেছে, নড়াইল সদরের গোবরা কাড়ার বিলে পুরুষের সঙ্গে খেতে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিক। কথা হলে তারা জানান, ধান, পাট, সবজি খেতে কাজ করা থেকে শুরু করে মাঠে পুরুষের পাশাপাশি সব কাজ করেন তারা। নারী শ্রমিক মালতি বিশ্বাস বলেন, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারী ও পুরুষ শ্রমিক একই সঙ্গে শ্রম বিক্রি করেন। প্রতিদিন পুরুষ শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন ৬০০-৬৫০ টাকা। একই কাজ করে নারী শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছেন তার অর্ধেক। যুগের পর যুগ এভাবে আমরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হলেও দেখার কেউ নেই।’

চার সন্তানের জননী নড়াইল সদরের মুলিয়া ইউনিয়নের ননীক্ষীর গ্রামের সুন্দরী বিশ্বাস কাকডাকা ভোরে মুলিয়া বিলে সবজি খেতে কাজ করতে এসেছেন অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে। অভাবের তাড়নায় প্রায় ৩০ বছর ধরে পরের জমিতে শ্রম বিক্রি করেন তিনি। এখন তিনি ষাটোর্ধ্ব। বয়সের ভারে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। সারা জীবনই তিনি তিনের এক ভাগ অথবা অর্ধেক মজুরিতে শ্রম বিক্রি করেছেন। তিন যুগ ধরে মজুরি বৈষম্যের শিকার এ নারী শ্রমিকের প্রশ্ন তার বেতন আর কবে বাড়াবে। শুধু সুন্দরী বিশ্বাসই নয়, নড়াইল সদরের মুলিয়া, শেখহাটি, তুলারামপুর ইউনিয়নসহ জেলার বিভিন্ন বিলে-খেতে গেলে চোখে পড়বে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করছেন হাজারো নারী শ্রমিক। 

নারী শ্রমিক শাপলা বেগম বলেন, ‘পুরুষের সমান কাজ করি আমরা। একই সঙ্গে কাজ করা পুরুষ শ্রমিকরা সঠিক শ্রমের মূল্য পেলেও আমাদের মজুরি দেয়া হচ্ছে অনেক কম। সকাল থেকে বিকাল অবধি কাজ করে পুরুষ শ্রমিক ৬০০-৭০০ টাকা নিয়ে বাড়ি যান। নারীরা ৩০০-৩৫০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন।’

মুলিয়া ইউনিয়নের ননীক্ষীর গ্রামের নারী শ্রমিক লাবণী বিশ্বাস বলেন, ‘ছোট তিনটা ছেলেমেয়ে বাড়িতে রেখে সারা দিন খেতে কাজ করি। সন্ধ্যা হলে ৩০০ টাকা হাতে পাই। বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম ৩০০ টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চালাব। ’

নারী শ্রমিকদের ন্যায্য শ্রমমূল্যের দাবি উঠে এসেছে সহকর্মী পুরুষ শ্রমিকদের মুখেও। পুরুষ শ্রমিক ভুলু মিয়া বলেন, ‘সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করি। পুরুষরা যে কাজ করে নারীরাও সেই কাজ করে। অথচ নারীদের অনেক কম মজুরি দেয়া হয়। একজন পুরুষকে ৬০০ টাকা দিলে নারীদের দেয়া হয় ২৫০-৩০০ টাকা। নারীদেরও পুরুষের সমান মজুরি দেয়া হোক।’

আরেক শ্রমিক রমেশ পাল বলেন, ‘সরকার যেহেতু নারীদের সমান অধিকার দেয়ার কথা বলেছে তাহলে গৃহস্থরা (কৃষকরা) কেন  নারীদের  পুরুষের  সমান মজুরি দেবেন না।’

সমাজকর্মী অধ্যাপক মলয় কান্তি নন্দী বলেন, ‘যুগের পর যুগ নারীরা কৃষিকাজে শ্রম বিক্রি করলেও তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে না। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। নারীদের পেছনে ফেলে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মজুরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ রাখা ঠিক নয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীর ক্ষেত্রেও ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা দরকার।’ 

নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সমরেন বিশ্বাস বলেন, ‘এ জেলায় কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নেই। এখনো জেলায় উল্লেখ্যযোগ্য তেমন কোনো শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠেনি।  অন্যান্য কাজের সুযোগ না থাকার ফলে নারীদের এক প্রকার বাধ্য হয়ে কম মূল্যে কৃষিতে শ্রম দিতে হয়। পদ্মা ও কালনা সেতু হওয়ার ফলে জেলার বিভিন্ন এলাকায় কলকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। শিল্প-কলকারখানা যত বেশি গড়ে উঠবে পুরুষের পাশাপাশি নারীর তত বেশি কাজের সুযোগ হবে। তখন নারী শ্রমিকরা এ বেতন বৈষম্যের শিকার হবেন না।  পুরুষ ও নারী শ্রমিকদের সবসময় সমান মজুরি দেয়া উচিত।’

আরও