পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাজ্যে চলে যান বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সেখানে দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে ’৯৫ সালের দিকে দেশে ফেরেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আরো চারবার তিনি একই আসনে জেতেন। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় দলের মুখপাত্র হিসেবে তার বক্তব্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন পর্যবেক্ষকরা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ১৮তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পান তিনি।
তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় এবং জাতীয় নির্বাচনের পর মধ্যবর্তী নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরাগভাজন হন তিনি। দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ সিনিয়র অনেকের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ দূরত্ব বজায় থাকে ২০১৯ সালে সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
২০১৩ সালের ১৫ জুন সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপরীতে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। পরে ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দায়ী করেন।
সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বণিক বার্তাকে জানায়, ২০১৩ সালে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়, সবগুলোয়ই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা হেরে যান। সে সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের একটি বড় অংশের বক্তব্য ছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আশরাফ এমন এক সময় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, যা আওয়ামী লীগের জন্য প্রতিকূল ছিল। সে সময় শেখ হাসিনার কাছে তারা অভিযোগ করেন, ওই সময়ে এতগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন না দেয়া হলে সেগুলো আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হতো না। এছাড়া সৈয়দ আশরাফের কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপ করা যায়নি।
সূত্র আরো জানায়, নির্বাচনে জেতার পর পাঁচ মেয়রকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। সে সময় সৈয়দ আশরাফ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হোক। যদিও পাঁচ মেয়রের কেউই দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেয়ার বিষয়ে সৈয়দ আশরাফের অবস্থানকেও ভালোভাবে নেননি শেখ হাসিনাসহ দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকেই।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়। শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট ভোটে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় দেশে একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসেন তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত ও রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসে পরিস্থিতি সমাধানের চেষ্টা করেন। সে সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ আশরাফ।
ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের বিশেষ দূতকে দশম জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণার বিষয়ে অবহিত করা হয় এবং ওই নির্বাচন থেকে সরে আসার সুযোগ নেই বলে জানানো হয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগে গুঞ্জন ওঠে, বৈঠক চলাকালে সৈয়দ আশরাফ তারানকোকে মৌখিকভাবে পরবর্তী সময়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেকেই তখন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। দলটির তৎকালীন দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচন বর্জনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে যে বৈরী অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটি নিরসনে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। দলটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে। তবে জাতিসংঘের প্রতিনিধি আসার আগেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যায়। সংলাপে তারানকো আওয়ামী লীগকে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর তা থামানো সম্ভব নয়। ওই তফসিলে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল না। আবার আওয়ামী লীগও পুনরায় তফসিল ঘোষণার পক্ষে ছিল না। তবে সে সময় বিএনপির অংশগ্রহণে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি বা তারপর আরেকটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা ওঠে। এতে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে শুধু সৈয়দ আশরাফই একমত পোষণ করেছিলেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষপাতীও ছিলেন তিনি। তবে বিষয়টি গোপন ছিল। এ বিষয়ে সৈয়দ আশরাফের যুক্তি ছিল, বিএনপির মতো বড় একটি রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা ঠিক হচ্ছে না। বিষয়টি তিনি শেখ হাসিনাকেও জানিয়েছিলেন। এতে শেখ হাসিনা তার প্রতি ক্ষুব্ধ হন। আর তাতে মদদ দেয় দলের একটি অংশ।
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশ সফরকালে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সে সময় আমার এবং জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে তারানকোর বৈঠক হয়। তারা সিরিয়াসলি চেষ্টা করেছিলেন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনেকগুলো বৈঠক করেছেন। ওই সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটা গুঞ্জন উঠেছিল। তবে এর ভিত্তি কী ছিল বলতে পারব না।’
ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৪ সালের নির্বাচনের পর মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটা গুঞ্জন ছিল। তবে সেটা বিস্তারিত বলতে পারব না। সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনিও ছাত্রলীগ করেছেন। আমরাও ছাত্রলীগ করেছি। তার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের ছিল। এ বিষয়ে কখনো সরাসরি জিজ্ঞাসা করিনি, তিনিও কখনো বলেননি। কিন্তু হি ওয়াজ ফেয়ার, এটা আমাদের মনে হয়েছে। ২০১৪ সালে যেমন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেটা যে তিনি পছন্দ করতেন, সেটা আমার কখনো মনে হয়নি। হতে পারে তার মনে হয়েছিল একটা ইলেকশন ট্র্যাকে থাকা দরকার, সেটা তিনি সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বোঝানোর চেষ্টা করে তো লাভ নেই, শেখ হাসিনা তো সবকিছুরই ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি সেটি চর্চা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের ঊর্ধ্বে উঠে বা বাইরে গিয়ে কিছু ভাবতে পারেননি। দলের ওপর বিদ্রোহ করে কিছু করবেন, সেটা শুধু তিনি না, কোনো নেতাই সেই সাহস দেখাতে পারেননি। তবে তার আচার-আচরণ সবকিছুতেই গণতন্ত্র মনোভাবাপন্ন বা মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপারটা বোঝাই যাচ্ছিল যে তারা কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। নির্বাচনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে চারটা মন্ত্রণালয় দেবেন। এটা নিয়েও বেশ কথাবার্তা হয়েছিল। বিরোধী শিবিরের বিশেষ করে বিএনপিতে কথাবার্তা হয়েছিল যে চারটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমন স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন যেগুলো নির্বাচনে প্রভাব রাখে, এ ধরনের মন্ত্রণালয় যদি নিতে পারি, তাহলে ভালো হবে। তবে এ প্রস্তাবটা নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয়নি। আর প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রস্তাবটা আন্তরিকভাবে দিয়েছিলেন কিনা সেটাও যাচাই করার সুযোগ হয়নি। পরে দেখা গেছে শেখ হাসিনার কোনো প্রস্তাবেই আন্তরিকতা কখনই ছিল না। ওই সময়ে বিরোধীরা ওটা মেনে নিত কিনা সেটা অনুমান করা ছাড়া এর বাইরে আর কিছু বলা যাবে না।’
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত মন্ত্রিসভায় আবারো স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) মন্ত্রীর দায়িত্ব পান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কিন্তু ২০১৫ সালের ৯ জুলাই আকস্মিকভাবে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে অব্যাহতি দিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। আর এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে। এর কিছুদিন পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হলে সাধারণ সম্পাদক পদে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি সৈয়দ আশরাফ। তার স্থলাভিষিক্ত হন ওবায়দুল কাদের। আর সৈয়দ আশরাফকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়। তবে দলে তার প্রভাব কমে আসে। দলে তার ঘনিষ্ঠদেরও বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
অন্যদিকে রাজনীতি ও সরকারে একপ্রকার নীরব অবস্থানে চলে যান সৈয়দ আশরাফ। ২০১৭ সালে স্ত্রী শীলা আহমেদের মৃত্যুর পর তিনিও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মন্ত্রিসভার কাজেও অনিয়মিত হয়ে পড়েন। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ডের ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।