পর্যটন শহর কক্সবাজারের প্রাণ কলাতলী হোটেল-মোটেল জোন অঘোষিত বাস টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। এ এলাকার সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পরিবহন কাউন্টার। এসব কাউন্টারে দূরপাল্লার বাসের টিকিট বিক্রির পাশাপাশি সড়কের অর্ধেক দখল করে যাত্রী ওঠানো ও নামানো হয়। ফলে এ পর্যটন এলাকায় বেড়েছে যানজট ও দুর্ঘটনা। অনুমোদনহীন এসব বাস কাউন্টার ও অঘোষিত টার্মিনালে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একাধিক গ্রুপের মধ্যে সংঘাতের ঘটনাও ঘটে।
অভিযোগ রয়েছে, জেলা ও ট্রাফিক পুলিশ, বাস মালিক সমিতির নেতা, স্থানীয় সিন্ডিকেট মিলে অনুমোদনহীন এসব বাস কাউন্টার টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
তবে ট্রাফিক পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নয়, ওই এলাকার যাত্রীদের সুবিধার্থে সড়কের পাশে কাউন্টারে টিকিট বিক্রির কথা বলা হয়েছিল। টিকিট বিক্রি হলেও বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রী ওঠানো-নামানোর সিদ্ধান্ত ছিল। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের বৈঠকে অনিয়ন্ত্রিত কাউন্টারগুলো সরিয়ে নিতে একাধিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। এটা অবশ্যই উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হবে।’
কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশ ও টেকনাফ উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল লিংকরোড ও কলাতলী মোড়। ওই এলাকাকে তিন রাস্তার মাথাও বলা হয়। আবার ডলফিন মোড়ও বলা হয়। সড়কের তিনটি সংযোগ থাকায় কলাতলী মোড় থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও টেকনাফে যাওয়ার লোকজনও ওই এলাকায় জড়ো হয়। কলাতলী ঘিরে ছোট-বড় বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনের অঘোষিত স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। সড়কে গাড়ি পার্ক করে থাকায় কলাতলী এলাকায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। কলাতলীর উঠনিতে গ্রিনলাইন কাউন্টারের সামনে অনেক বাসের কারণে একাধিক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
বর্তমানে এ অঘোষিত বাস টার্মিনাল ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। দেখা গেছে হোটেল-মোটেল জোনের প্রায় হোটেলের পাশে খোলা হয়েছে বাস কাউন্টার। ফলে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তীব্র যানজট লেগে যায় ওই এলাকায়। এ সময় অসহায় হয়ে পড়ে ট্রাফিক পুলিশ। বর্তমানে কলাতলী মোড় হয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এলাকা থেকে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে কাউন্টারে ছেয়ে গেছে।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কলাতলী মোড় থেকে পুলিশ লাইন হয়ে সড়কের দুই পাশে শত শত বাস দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা হলে সেখান থেকে ঘুরে বাসগুলো লাবণী পয়েন্ট হয়ে হোটেল জোনে প্রবেশ করে। এরপর এসব কাউন্টার থেকে তোলা হয় যাত্রী। এ কারণে কক্সবাজার শহরের প্রবেশদ্বার ঝিলংজা এলাকায় বাস টার্মিনাল অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে করা টার্মিনালটি এখন মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে বাস টার্মিনালের মধ্যে দূরপাল্লার কোনো বাসের কাউন্টার নেই। পুরো ভবনটি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। যানবাহন না আসায় টার্মিনালে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার নামে বরাদ্দকৃত কাউন্টারগুলো বন্ধ। তবে টার্মিনালের ভেতর-বাইরে বান্দরবান, চকরিয়া, টেকনাফ, উখিয়া, চট্টগ্রামের কিছু কাউন্টার রয়েছে। সেখান থেকে দিনের বেলায় নামেমাত্র কয়েকটি বাস ছেড়ে যায়।
ভবনের পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আবর্জনা। ভবনের মেঝের টাইলস ভাঙা। দেয়ালের বিভিন্ন অংশে দেখা দিয়েছে ফাটল। আর দ্বিতীয় তলায় হোটেলের ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে পুরো ভবন। টার্মিনালের উত্তর পাশে শুধুই আবর্জনা, গরু-মহিষ আর ছাগলের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে টার্মিনাল এলাকা মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীসহ অপরাধীদের আস্তানা হয়ে ওঠে। টার্মিনালের অভ্যন্তরে একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল সেটিও এখন নেই।
বাস টার্মিনাল হয়ে পুলিশ লাইন ও হোটেল জোনে দেখা গেছে, টার্মিনাল থেকে কলাতলী মোড় পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে শত শত বাস দাঁড় করে হয়েছে। সেখানে সড়কের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে কয়েকটি বাসে যাত্রী তোলা হচ্ছে। ফলে এ সড়ক ব্যবহারকারীদের যানজটে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়।
শ্রমিক ইউনিয়নের নামে কয়েকজনকে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করতেও দেখা যায়। আবার কলাতলী মোড় ও হোটেলের সামনে পর্যটকরা এলে ঘিরে রাখে দালালচক্র। তারা ভালো কক্ষ ও মূল্য হ্রাসের প্রলোভন দেখিয়ে পর্যটককে টানাহেঁচড়া করে নির্দিষ্ট হোটেলে নিয়ে যায়।
কক্সবাজার জেলা কোচ-বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নূর মোহাম্মদ খুইল্যা মিয়া বলেন, ‘এলাকার মানুষের সুবিধার জন্য ঝিলংজা এলাকায় বাসটার্মিনাল করা হয়েছে, কিন্তু এখন কয়েকটি প্রভাবশালী চক্র টার্মিনালকে অকেজো করে শহরের লালদীঘিরপাড় ও হোটেল-মোটেল জোনে বাসটার্মিনাল গড়ে তুলেছে। বর্তমানে ৩৭টি গাড়ি কোম্পানি কক্সবাজারে ব্যবসা করে যাচ্ছে।’
কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পৌরসভার বাস টার্মিনাল তো আছে। আমরা হোটেল জোনে বাস টার্মিনাল বা কাউন্টার করার জন্য কাউকে অনুমোদন দেইনি। তাই কারো কাছ থেকে আয়কর নেয়ার প্রশ্নই আসে না।’
হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে এ ব্যাপারে অনেক প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু সুরাহা হচ্ছে না। কলাতলী এখন বাসস্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। এ কারণে সৌন্দর্য হারাচ্ছে পর্যটন নগরী।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান বলেন, ‘তাদের বলে দিয়েছি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা যেন সৃষ্টি না হয়। টার্মিনালটি সচল করার পাশাপাশি শহরের বাইরের বাস, ট্রাকসহ যানবাহনগুলোকে সেখানে নেয়ার চেষ্টা করছি। কেউ যদি এ নির্দেশ না মানে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’