চার দশক আগে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি শুরু করে সরকার। আশির দশকে কিছুটা ধীরগতি দেখা গেলেও নব্বইয়ের দশক থেকে আবার তা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে। কিন্তু এ চার দশকে দক্ষ জনশক্তির তুলনায় অদক্ষ জনশক্তিই বেশি রফতানি করতে হয়েছে সরকারকে। ফলে সংখ্যার দিক থেকে রফতানি বাড়লেও হার অনুযায়ী দক্ষ কর্মী পাঠানোর পরিমাণ বাড়ছেই না। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রকাশিত তথ্যে এমন চিত্র দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষতা অর্জনে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের অনীহা, জাতীয় শিক্ষানীতির দুর্বলতা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র না থাকা, জনসচেতনতা ও প্রবাসী কর্মীদের নিয়ে সরকারের যথাযথ পরিকল্পনার অভাবেই জনশক্তিকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলে বিদেশে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না।
বিএমইটির তথ্যানুযায়ী, ১৯৯১ সালে ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৫৬ জন জনশক্তি প্রেরণ করে বাংলাদেশ। তার মধ্যে ৩১ দশমিক ৮৭ শতাংশ দক্ষ, ২২ দশমিক ১৫ আংশিক দক্ষ এবং ৩৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ ছিল অদক্ষ শ্রমিক। কিছুটা ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে কর্মী পাঠানোর সমান্তরাল হার চলে তিন দশক ধরে। ২০২১ সালে সে হারে বড় ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। সে বছর ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন কর্মী বিদেশ প্রেরণ করা হলেও তার বিপরীতে দক্ষ কর্মী যায় ২০ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আংশিক দক্ষ কর্মী যায় ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। সে বছর বিদেশে পাঠানো মোট কর্মীর ৭৩ দশমিক ৫৬ শতাংশই ছিল অদক্ষ।
অন্যান্য বছরের মধ্যে ১৯৯৬ সালে ৩০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ১৬ দশমিক ৩৮ আংশিক দক্ষ এবং ৫১ দশমিক ৭৩ শতাংশ অদক্ষ। ২০০১ সালে ২২ দশমিক ৬৫ শতাংশ দক্ষ, ১৬ দশমিক ২৩ আংশিক দক্ষ এবং ৫৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ অদক্ষ শ্রমিক রফতানি হয়। ২০০৬ সালে পাঠানো কর্মীর মধ্যে ৩০ দশমিক ২৬ শতাংশ দক্ষ, ৮ দশমিক ৯০ আংশিক দক্ষ এবং ৫৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ অদক্ষ শ্রমিক রফতানি হয়। ২০১১ সালে দক্ষ শ্রমিকের হার কিছুটা বেড়ে ৪০ দশমিক ৩৩ শতাংশে দাঁড়ায়। এ বছর আংশিক দক্ষ শ্রমিকের পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং অদক্ষ শ্রমিক যায় ৫৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। এ বছর ৪২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ দক্ষ, ১৫ দশমিক ৮২ আংশিক দক্ষ এবং ৪০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ অদক্ষ শ্রমিক রফতানি হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কা তৈরি হয় ২০২১ সালে। এ বছর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে অদক্ষ শ্রমিক প্রবাসী হয়েছেন।
এত বড় সংখ্যক অদক্ষ কর্মী দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে গলদই এমন দশার কারণ। অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীই এক পাতা ইংরেজি লিখতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটা প্রবন্ধ লিখতে পারে না। এজন্য আমরা দক্ষ কর্মী পাই না। আমাদের কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, জাতিগতভাবে দক্ষতার প্রতি নজর দিতে হবে, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন করে দক্ষতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করতে পারলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব।’
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে, দক্ষ কর্মী না হওয়ায় বাংলাদেশী অভিবাসীদের মাসিক আয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। একজন বাংলাদেশী অভিবাসীর গড় মাসিক আয় ২০৩ দশমিক ৩৩ ডলার। অন্যদিকে ফিলিপাইনের একজন অভিবাসীর গড় মাসিক আয় ৫৬৪ দশমিক শূন্য ১ ডলার।
বিএমইটির তথ্যমতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ২৯ লাখ ৬ হাজার ৪৬১ জনকে প্রবাসে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে ৩৩ দশমিক ৭২ শতাংশ দক্ষ, ১৪ দশমিক ৯৯ আংশিক দক্ষ এবং ৪৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ অদক্ষ জনশক্তি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমইটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জাপান, চীন বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে চায়। আগ্রহীদের আমরা বলি, তোমরা জাপানিজ, চাইনিজ ভাষা শেখো, তোমাদের চাকরি হবে। কিন্তু তারা এ নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায় না। কোরিয়ায় আমরা কর্মী পাঠাব, ১০০ জন কর্মী পরীক্ষা দিলে দুজনও ভালোভাবে টেকে না। আমরা তো আর তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে পারি না। আমি আমার গ্রামে, ইউনিয়নে গিয়েও মানুষকে প্রশিক্ষণ নেয়ার বিষয়টি বুঝিয়েছি। কিন্তু সম্ভব হয় না। তাদের বক্তব্য—প্রশিক্ষণ নিলে বিদেশ নিয়ে যাবে কিনা?
বিএমইটির অধিভুক্ত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর কয়েকজন অধ্যক্ষ জানান, অর্থ উপার্জনে মানুষ বিদেশে পাড়ি দেয়। এটা যেমন তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, জোর করে বিদেশ পাঠাতে পারি না, একইভাবে আমরা তাদের প্রশিক্ষণ নিতেও বাধ্য করতে পারি না। যারা বিদেশ যায় তাদের অধিকাংশই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে চায় না। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর পক্ষ থেকে থেকে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, ক্যাম্পেইন করা হয়, লিফলেট বিতরণ করা হয়, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছানো হয়। কিন্তু বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের আমরা প্রশিক্ষণে আগ্রহী করতে পারি না।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘সৌদি আরবে আমাদের ১৫-২০ লাখের বেশি শ্রমিক থাকে, যুক্তরাষ্ট্রে এত শ্রমিক নেই। তার পরও সৌদি আরবের সমান রেমিট্যান্স আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাই। আমরা শুধু কর্মী পাঠাচ্ছি, কিন্তু তার বিপরীতে রেমিট্যান্সের দেখা নেই। আমাদের শ্রমিকদের বড় একটি অংশই অদক্ষ। ফলে এখান থেকে বিদেশ যেতে বেশ অর্থ ব্যয় হয়, তার বিপরীতে আয় হয় অনেক কম। শ্রমিকরা অদক্ষ হওয়ার কারণে এ ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয়। সেজন্য দক্ষ কর্মীর গুরুত্ব সবসময় বেশি। মানুষকে বোঝাতে হবে, দক্ষ হয়ে বিদেশ গেলে কয়েক গুণ বেশি আয় করা যায়।’
বিএমইটির প্রশিক্ষণ পরিচালনা শাখার পরিচালক প্রকৌশলী মো. সালাহ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিএমইটির আগে ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) ছিল। সম্প্রতি আরো ৪০টি যোগ হলো। আমাদের যত টিটিসি আছে, সবগুলোয় একসঙ্গে প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও মাত্র ৪০ হাজার প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব। এর বিপরীতে চাহিদা অনেক। আমাদের সক্ষমতা ৪০ হাজারের, কিন্তু প্রশিক্ষণ দিই ৮০ হাজারকে। আগে কাঁচামালের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ছিল না, মেশিনারিজের বরাদ্দ স্বল্প ছিল। করোনা মহামারীর পর আমাদের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, আমরা কোর্স কারিকুলাম যুগোপযোগী করে সাজাচ্ছি। আশা করি, সামনের বছরগুলোয় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীদের বিদেশ পাঠাতে পারবে বিএমইটি।’