খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চাল-আটার ভার সবচেয়ে বেশি

আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে, যা গত এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরই মধ্যে এ খাদ্য মূল্যস্ফীতির পেছনে কোন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি দায়ী, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতনরা দাবি করছেন, মুরগি ও ডিমের মূল্যবৃদ্ধিই খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতির হিটম্যাপ অনুযায়ী, খাদ্য

আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে, যা গত এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরই মধ্যে এ খাদ্য মূল্যস্ফীতির পেছনে কোন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি দায়ী, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতনরা দাবি করছেন, মুরগি ও ডিমের মূল্যবৃদ্ধিই খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতির হিটম্যাপ অনুযায়ী, খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে মাংস ও ডিমের ভূমিকা খুবই সামান্য। বরং দানাদার খাদ্যশস্য (চাল-আটাসহ ধান ও গম উদ্ভূত পণ্য), মাছ-শুঁটকি শ্রেণীর পণ্য ও মসলার প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ইউনিটের সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির হিটম্যাপ অনুযায়ী, সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্য, পানীয় এবং তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ভার ৫৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যের ভার ৫২ দশমিক ১৭ শতাংশ। খাদ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভার দানাদার খাদ্যশস্য চালের, যা ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর পরই বেশি প্রভাব রাখা খাদ্যপণ্যের মধ্যে মাছ ও শুঁটকির ভার ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ডিম ও মাংসের ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ, সবজি ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ, মসলা ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। এছাড়া চাল ব্যতীত আটাসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের ভার ১ দশমিক ৩০ শতাংশ, ডাল ১ দশমিক ৫১ শতাংশ, ফল ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ভোজ্যতেল ও চর্বি ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য ২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের ভার ২ দশমিক ২৪ শতাংশ। 

আর পানীয়ের ভার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ভার ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যবহির্ভূত বিভিন্ন সেবার ভার ৪৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হিট ম্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিজস্ব হিসাবায়নের পাশাপাশি পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য আমলে নেয়া হয়।

যদিও ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ গত এক বছরে দেশে খাদ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে আলু, বিভিন্ন ধরনের মসলা, মাছ, চিনি ও ডিমের। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত ৩১ আগস্টে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয় ৪২-৪৫ টাকায়। গত বছরের এ সময়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ২৪-৩০ টাকা। অর্থাৎ আলুর দাম এক বছরের ব্যবধানে ৬১ শতাংশের বেশি বেড়েছে। একইভাবে চিনির দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।

এদিকে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে বিভিন্ন মসলা জাতীয় পণ্যের। একই সময়ে দেশী পেঁয়াজের দাম ৭৯ শতাংশ, দেশী রসুনে ২২৮ শতাংশ, হলুদ ৩১ শতাংশ, দেশী আদা ২৩৪ শতাংশ এবং জিরার দাম ১২৫ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরে মাংসের মধ্যে ব্রয়লার মুরগির দাম ৩ শতাংশ, খাসি ১৬ শতাংশ, দেশী মুরগি ২৫ শতাংশ এবং গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ। আর ডিমের দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ।

এদিকে গত এক বছরে বিভিন্ন মাছের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত মাসে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে রুই ও কাতলা প্রতি কেজি ৩৫০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তেলাপিয়ার কেজি ২৩০-২৬০ টাকা এবং পাঙাশ ২২০-২৪০ টাকায় বিক্রি হয়। যদিও এক বছর আগে রুই ও কাতলা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছিল ২৫০-৩৫০ টাকা। আর তেলাপিয়া ও পাঙাশের কেজি ছিল ১৬০-১৯০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মাছের দাম বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ।

চলতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাছের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় দাম বাড়ছে। গত জুলাই পর্যন্ত অনেকটা বৃষ্টিহীন ছিল। এর মাঝে ছিল তীব্র তাপপ্রবাহ। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক মৎস্য খাতে। মাছের প্রজনন মৌসুম সাধারণত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি—এ ছয় মাস। কিন্তু এ বছর খরা, তাপপ্রবাহ ও জলাশয়ে কম পানির কারণে চাহিদা সীমিত থাকায় পর্যাপ্ত রেণু পোনা উৎপাদন করতে পারেননি হ্যাচারি মালিকরা। আবার জলাশয়ে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মাছের সরবরাহও ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কম। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত জুলাইয়েও মূল্যস্ফীতি হার ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চে ঠেকেছে। চলতি বছরের প্রথম দিকেও খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রবণতা নিম্নগামী ছিল। জানুয়ারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশে। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করে। বছরের দ্বিতীয় মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং মার্চে ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আবার এপ্রিলে এ হার কিছুটা কমলেও মে মাস থেকে আবারো বাড়তে শুরু করে। মে ও জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৯ দশমিক ২৪ ও ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে। 

যদিও গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় আগস্টে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে ডিম ও মুরগির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ সময় তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, এটাকে অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করব। শিগগিরই এটা কমানোর চেষ্টা করব। আগস্টে মূল্যস্ফীতির নায়ক মুরগি ও ডিম। মুরগি-ডিমের উচ্চমূল্যের কারণে মূলত গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং সেটা অন্যান্য খাদ্যপণ্যকে প্রভাবিত করেছে।’

তবে পরিকল্পনামন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে শুধু ডিম ও মুরগির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করার সুযোগ নেই। এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের পণ্যবাজার অস্থিতিশীল। ভোগ্যপণ্য ছাড়াও বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে চিনি, মাছ, সবজি, বিভিন্ন মসলা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ-তিন গুণও হয়েছে। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভার হিসাব করলে মূল্যস্ফীতিতে ডিম ও মুরগির ভার তো খুব বেশি নয়। ডিম ও মুরগির মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে বড় কোনো কারণ নয়। বড় কারণ অন্যকিছু। ম্যাক্রোইকোনমিক্সের প্রথম কথা মুদ্রা সরবরাহ সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর কারণেও মূল্যস্ফীতিতে একটি প্রভাব রয়েছে। আবার আমদানীকৃত খাদ্যপণ্য যদি হয় তাহলে অবশ্যই বাড়বে। মসলার বেশকিছু অংশ আমদানি হয়। ফলে এর দাম বেশি বেড়েছে।’

সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মূল কারণ হলো টাকা অবমূল্যায়ন। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এবং টাকা পাচারের কারণে টাকার মান কমে যাচ্ছে। আবার অনেক খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। ফলে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে দাম বাড়ছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য সরকারের খাদ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দায়ী। খাদ্য ব্যবস্থাপনার অভাবের কারণেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। কাঁচামরিচ, আলু, পেঁয়াজ, আদার দাম বৃদ্ধির চিত্র দেখলেই এটি বোঝা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সিন্ডিকেশন। সিন্ডিকেশনের প্রভাবে হঠাৎ করে বিভিন্ন পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। এর কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মাছ, মসলা ও সবজিসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দামই বেড়েছে। ডিম ও মুরগির দাম বেড়েছে। কিন্তু এটাই মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে না।’

সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘সরকারের নীতিগত হস্তক্ষেপের কারণে বৈশ্বিক খারাপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি দুই অংকের মধ্যেই ছিল, তা নাহলে মূল্যস্ফীতি ১৩ থেকে ১৪ শতাংশে পৌঁছে যেত। আশা করছি, নভেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি আবার কমতে শুরু করবে। বিভিন্ন ধরনের আমদানি পণ্যে সরকার ট্যাক্স কমিয়ে নিয়ে এসেছে। সরবরাহ ঠিক রাখতে কৃষকদের ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পলিসি রেট দুবার বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমিয়েছে। ব্যাংকের ঋণের সুদহারের ক্যাপ তুলে দেয়া হয়েছে।’

আরও