দেশে পোলট্রি শিল্পের প্রসারের সঙ্গে বাড়ছে ভুট্টার চাহিদা ও উৎপাদন। একই সঙ্গে বাড়ছে আমদানির পরিমাণও। পোলট্রির পাশাপাশি পশু ও মৎস্য খাদ্যেরও অন্যতম প্রধান উপকরণ ভুট্টা। গবাদিপশুকে ঘাস হিসেবেও খাওয়ানো হয় এর গাছ। আবার মানুষের বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের তালিকায়ও ভুট্টার ব্যবহার অনেক। তৈরি হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত খাবার। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভালো দাম পাওয়ায় ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন কৃষক। গত এক দশকে আবাদি জমি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবহাওয়া উপযোগী জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে সার্বিকভাবে কৃষক ও ভোক্তা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবেন।
ভুট্টার উৎপাদন বৃদ্ধি এবং শস্যটির ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিডব্লিউএমআরআই)। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীন ছিল। বিডব্লিউএমআরআই থেকে এ পর্যন্ত ২০টি হাইব্রিড জাত ও নয়টি কম্পোজিট জাতের ভুট্টা উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহফুজুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছি। এখন জোর দেয়া হচ্ছে জলবায়ুসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে। দক্ষিণাঞ্চলেও ভুট্টা চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। এ বছর কয়েকটি জেলায় মাঠপর্যায়ে আবাদের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। আমাদের উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে বিডব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা-২ খুব ভালো ফলন দিচ্ছে। হেক্টরপ্রতি মিলছে ১২-১৪ টন। এছাড়া তাপসহিষ্ণু তিনটি ও খরাসহিষ্ণু দুটি জাত উদ্ভাবন হয়েছে।’
সরকারি হিসাবে দেশে বর্তমানে ভুট্টার চাহিদা ৬০-৬৫ লাখ টন। যদিও প্রায় সমপরিমাণ এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ভুট্টা চাষ হয়েছে ৬ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের পরিমাণ ৬৪ লাখ ২২ হাজার টন। যদিও এক দশক আগে অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাত্র ৩ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে খাদ্যশস্যটি চাষ করে ২১ লাখ ২৩ হাজার টন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছিল। সে হিসাবে এক দশকে আবাদি জমি বেড়েছে দ্বিগুণ আর উৎপাদন হয়েছে প্রায় তিন গুণ বেশি ভুট্টা। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে ভালো ফলন হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে ৫৬ লাখ ২৯ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছিল। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ৪১ লাখ ১৬ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে ৪০ লাখ ১৫ হাজার টন ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে গমের আমদানি কমে যাওয়া এবং ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহারের কারণে খাদ্যশস্যটির চাহিদা বেড়েছে। তবে দেশে চাহিদার সমপরিমাণ উৎপাদন হলেও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ লাখ ৬৩ হাজার ৪৩২ টন ভুট্টা আমদানি করতে হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে অবশ্য ২১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৯ টন ভুট্টা আমদানি হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে ভুট্টা আনতে হয়েছে ২৪ লাখ ৫৬ হাজার ৮০৬ টন। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৩২ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি করতে হয়েছে ১২ লাখ ৪৪ হাজার ২১১ টন ভুট্টা।
এদিকে ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য করা কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান—সিআইপি১-এর চেয়ে সিআইপি৩ অর্থাৎ ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভুট্টার আবাদের হার অনেক বেড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চফলনশীল, লাভজনক ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে গমের স্থান দখল করছে ভুট্টা। ‘ন্যাশনাল ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি পলিসি প্ল্যান অব অ্যাকশন অ্যান্ড বাংলাদেশ থার্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান মনিটরিং রিপোর্ট ২০২৩’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ভুট্টার আবাদি জমি বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ। একই সময়ে গমের আবাদ কমেছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। আবার ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ভুট্টার আবাদি জমি বৃদ্ধি পেলেও গমের জমি কমেছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হারে।
পোলট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পোলট্রি খাদ্য তৈরিতে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ ভুট্টার ব্যবহার হয়। পশুখাদ্যে ভুট্টার ব্যবহার প্রায় ১২ শতাংশ। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ঘাসের পরিবর্তে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভুট্টার সাইলেজ। দৈনিক দানাদার খাদ্যের চাহিদা প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে এ গোখাদ্য। আবার মৎস্য খাদ্যেও প্রায় ১০-১৫ শতাংশ ভুট্টার ব্যবহার হয়।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক দশকে (২০০৯-১৯) বাংলাদেশে জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ভুট্টা, পাট, মাংস ও দুধ উৎপাদন। এর পরই রয়েছে কন্দাল ফসল, উদ্যান ফসল, ডাল ও তেল শস্য উৎপাদন এবং মৎস্য চাষ। তবে কৃষকের জীবনমানে সবচেয়ে কম প্রভাব ফেলছে ধান উৎপাদন। কৃষকের দরিদ্রতা কমিয়ে আনতেও বড় ভূমিকা রাখছে ভুট্টার চাষাবাদ।
ভুট্টা উৎপাদন করে বাজারমূল্য ভালো পাওয়া যায় বলে জানান নওগাঁ সদর উপজেলার বাঁচারি ইউনিয়নের কৃষক আহসান হাবিব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রতি বিঘা জমিতে ভুট্টা উৎপাদনে সব ধরনের খরচ বিবেচনায় নিলে প্রায় ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। উৎপাদনশীলতা ভালো থাকায় ৪০ মণের মতো ভুট্টা পাওয়া যায় প্রতি বিঘায়। গত বছর এক মণ ভুট্টা ১ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পেরেছি। অর্থাৎ ৪০ মণ ভুট্টা ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য ফসলে ভুট্টার মতো এত লাভ হয় না। তাছাড়া এখন ভুট্টার চাহিদা বেশি। বহুমুখী ব্যবহারের কারণে ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে।’
এসিআই এগ্রো লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. এফএইচ আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভুট্টায় প্রতি হেক্টরে আট থেকে ১৪ টনের মতো উৎপাদন হয়ে থাকে। এতে উৎপাদন খরচ কম। আবার বাজারে দামও ভালো। ফলে এখানে কৃষক আয় করতে পারেন বেশি।’