১০ বছরে নড়াইলে বোরো চাষের জমি বেড়েছে ১০ হাজার হেক্টর

চলতি মৌসুমেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে আবাদ

নড়াইলে দিন দিন বোরো আবাদের দিকে ঝুঁকছেন কৃষক। প্রতি বছরই বাড়ছে বোরো আবাদের জমির পরিমাণ।

নড়াইলে দিন দিন বোরো আবাদের দিকে ঝুঁকছেন কৃষক। প্রতি বছরই বাড়ছে বোরো আবাদের জমির পরিমাণ। এক দশকে জেলায় বোরো আবাদের জমি বেড়েছে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর, যা মোট জমির ২৫ শতাংশ। 

বর্তমানে বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে দুলছে সবুজ ধান গাছ। এবারো বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছেন কৃষক। সবকিছু ঠিক থাকলে বছর জেলায় লাখ ২০ হাজার ৭৩০ টন ধান উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জেলার প্রান্তিক কৃষক জ্বালানি তেলের দাম কমানো, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১০ বছর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে জেলায় বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল ৩৯ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে। চলতি বছর ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ৫০ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে। ফলে ১০ বছরে জেলায় বোরো আবাদ বেড়েছে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষক জানান, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিজুড়ে বোরো ধানের চারা জমিতে রোপণ করতে হয়। এপ্রিল-মে মাসে জমি থেকে পাকা ধান ঘরে তোলেন তারা। বোরো খেত পরিচর্যায় কৃষকের ব্যস্ততার ছবি এখন নড়াইলের মাঠে মাঠে। ভালো ফলন পেতে সার ছিটানো, সেচ দেয়াসহ খেতের নানা পরিচর্যায় সকাল-সন্ধ্যা পার করছেন কৃষক। কৃষি উপকরণের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধিতে চাষাবাদ দুরূহ হয়ে পড়লেও নিরুপায় কৃষক পূর্বপুরুষের পেশা আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন। তাদের একটিই চাওয়া, ঘাম ঝরানো ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক।

জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নড়াইলের তিনটি উপজেলার মধ্যে লোহাগড়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে জেলার কাড়ার বিল, নলদিরচর বিল, মরিচপাশার বিল, চাচই বিল, আকদিয়ার বিল, রুইয়ের বিল, কৈয়ের বিল, ভাটিয়ার বিল, খলিয়ার বিল, হবশাত্রার বিলমুলিয়ার বিল, আইড়োর বিল, বিল ইছামতীর বিল, নুন জলার বিল, নলাবিল মাইজ পাড়ার বিলে বোরো আবাদ বেশি হয়েছে।

নড়াইল সদর উপজেলার আমাদা গ্রামের কৃষক আবু সাদেক বলেন, ‘আগে এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ২০ মণ ধান হতো। এখন এক বিঘা জমিতে ৩০-৩৫ মণ ধান পাওয়া যায়। এজন্য বেশি জমিতে বোরো আবাদ করেছি।

লোহাগড়া উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের কৃষক ফুল মিয়া বলেন, ‘আগে বিদ্যুতের অভাবে সেচ দেয়া যেত না। তখন পাম্প বন্ধ রাখতে হতো। এখন আগের তুলনায় বেশি সময় বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। ফলে খেতে পানি দিতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। আগামী দেড় মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি তার।

সদর উপজেলার মূলদাইড় গ্রামের কৃষক শাহিন জানান, বর্তমানে এক লিটার ডিজেলের দাম ১০৯-১১৫ টাকা। এত বেশি দামে তেল কিনলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তেলের দাম কমানোর জন্য দাবি করেন তিনি।

একই গ্রামের কৃষক মশিউর রহমান বলেন, ‘বিলের খাল খননের ফলে শত শত কৃষক বোরো আবাদ করতে পারছেন। খালটি খননে বোরো চাষীরা লাভবান হয়েছেন। এলাকায় বোরো আবাদ বেড়েছে।

লোহাগড়া উপজেলার চাচই গ্রামের কৃষক রবিউল সরদার জানান, খালে পানি না থাকায় কয়েক বছর আগে তারা জমিতে বোরো আবাদ করতে পারতেন না। তখন বছরে দুটি ফসল হতো। খাল খননের ফলে বর্তমানে তারা জমিতে বছরে তিনটি ফসল ফলান। এখন তিনি জমিতে বোরো আবাদ করতে পারেন।

আমাদা গ্রামের কৃষক সেলিম হোসেন বলেন, ‘ বছর প্রায় দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছি। বিলের মধ্যে প্রভাবশালীরা অপরিকল্পিতভাবে ঘের বানানোর কারণে বেশকিছু জমি এখনো জলাবদ্ধ অবস্থায়। কারণে বেশকিছু অংশে বোরো আবাদ করতে পারিনি।

ছাত্রা গ্রামের কৃষক তমাল বলেন, ‘আগামী দুই মাস বোরো খেতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করতে হবে। সময়মতো পানি দিতে না পারলে কয়েক হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

নড়াইল সদরের মুলিয়া গ্রামের কৃষক সুজিত বিশ্বাস বলেন, ‘ একর ২০ শতক জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলাম। ফলন   দাম ভালো পেয়েছি। তাই বছর একর ৪৫ শতক জমিতে বোরো আবাদ করেছি। আশা করছি এবারো ধানের বাম্পার ফলন ন্যায্যমূল্য পাব।

কৃষক নেতা কাজী বাছাক বলেন, ‘আমন মৌসুমে একটু লাভের মুখ দেখে সেই কৃষকেরাই বোরো ধান আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেক কৃষক তার জমিতে অন্যবারের তুলনায় বোরো আবাদ বৃদ্ধি করেছেন। লাভ-লোকসান যাই হোক পূর্বপুরুষের পেশা আঁকড়ে ধরেই একটু ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

নড়াইল পৌরবিদ্যুৎ অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নাসির উদ্দিন বলেন, ‘কৃষকের মাঝে যথাযথভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। বোরো আবাদের কথা চিন্তা করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবারহ করা হয়। রাত ১১টার পর থেকে কৃষককে পাম্প চালানোর পরামর্শ দেন তিনি।  

নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, ‘উন্নতমানের বীজ সরবরাহ, সময়মতো কৃষক সার কীটনাশক পাওয়ায় ধারাবাহিকভাবে নড়াইলে বোরো আবাদ বাড়ছে। আগামী দুই মাস বোরো আবাদের কথা ভেবে কৃষকের মাঝে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অনুরোধ করব। আশা করছি, বছর বোরো আবাদে বাম্পার ফলন পাবেন জেলার কৃষক।

আরও