পাহাড়ে কুল উৎপাদন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ

মৌসুমি ফল ও উদ্যান ফসল উৎপাদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের খ্যাতি দীর্ঘদিনের। আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে ফলদ বাগানের প্রতি আগ্রহ রয়েছে তিন পার্বত্য জেলার মানুষের।

মৌসুমি ফল ও উদ্যান ফসল উৎপাদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের খ্যাতি দীর্ঘদিনের। আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে ফলদ বাগানের প্রতি আগ্রহ রয়েছে তিন পার্বত্য জেলার মানুষের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমিতে কুল আবাদ হয়েছে। উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৮৮৬ টন। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদ হয় ২ হাজার ৪৯৬ হেক্টর জমিতে। উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ২০ হাজার ৫৪৬ টন। অর্থাৎ পাহাড়ে কুল চাষের জমির পরিমাণ খুব একটা না কমলেও ফলন কমেছে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। 

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে কুল আবাদ বেশি হয় বান্দরবানে। এবার মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে তিন জেলাতেই উৎপাদন কমেছে বলে মনে করছেন চাষী ও কৃষি কর্মকর্তারা। 

রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা উত্তম কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আগে বাউকুল, আপেল কুল, দেশীয়সহ কয়েকটি জাতের আবাদ হতো। এখন বিভিন্ন জাতের আবাদ বেড়েছে। আগের চেয়ে বাগান সৃজন ও উৎপাদন বাড়ার কথা, কমা তো ভাবনার বিষয়।’ 

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাউ কুল, আপেল কুল, নারকেল কুল, বলসুন্দরী, কাশ্মীরি কুল, ভারত সুন্দরীসহ দেশীয় জাতের কুল আবাদ হচ্ছে। খেতে টক হওয়ায় দেশী জাতের কুলের চাহিদা কম। তবে মিষ্টি কুলের চাহিদা রয়েছে। আকার ও মান অনুযায়ী স্থানীয় বাজারে কেজিপ্রতি ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সোনারাম কারবারিপাড়ায় বাড়ির আঙিনায় পাহাড়ি ঢালু জমিতে মিশ্র ফল বাগান সৃজন করেছেন সৃজন সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার মিশ্র ফল বাগানে চার জাতের মিলে এক হাজার কুল গাছ রয়েছে। বলসুন্দরী, মিষ্টি ও আপেল কুলের চাহিদা এবং বাজারদর ভালো থাকায় এ চারটি জাতের কুল গাছ সৃজন করেছি। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার বিক্রি করেছি। আরো ৪-৫ লাখ টাকার ফল বিক্রির সম্ভাবনা আছে।’ 

সদর উপজেলার মানিকছড়ি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোহেল রানা বলেন, ‘সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তিন একর জমিতে মিশ্র বাগান গড়ে তুলেছেন। তার বাগানে এক হাজার গাছ রয়েছে। গতবারের তুলনায় এবার সেখানে ফলন কিছুটা কমবে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তখন হয়নি। আবার পরে যখন বৃষ্টি হয় তখন বাগানে যেসব ফুল আসছিল সেগুলো ঝরে গেছে। কিন্তু যেগুলো মটরদানা আকৃতির ছিল সেগুলোর ফলন ভালো হয়েছে।’ 

রাঙ্গামাটি জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপা বাজারে গতকাল বলসুন্দরী, আপেল কুলসহ বিভিন্ন জাতের বরই বিক্রি হয়েছে ১০০-১৫০ টাকায়। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি থেকে আসা রিংকু চাকমা জানান, তিনি বলসুন্দরী কুল ১২০-১৩০ টাকায় এবং আপেল কুল ১৪০ বিক্রি করছেন। আকারভেদে বলসুন্দরী কুল ১০০-১৪০ এবং আপেল কুল ১২০ টাকায়ও বিক্রি করছেন অনেকে। কয়েকজন বিক্রেতা দেশী কুল ১২০ টাকা, বল সুন্দরী ১০০, বেবী কুল ১২০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। আর চাষীরা পাইকারিতে বিক্রি করছেন মানভেদে ৯০-১২০ টাকায়। বনরূপা মোড়ের খুচরা ব্যবসায়ী হৃদয় বল জানান, আকার ও মানভেদে বাজারদর ওঠানামা করে। রিংকু চাকমা নামের আরেক বিক্রেতা জানান, তিনি বলসুন্দরী কুল ১২০-১৩০ টাকা কেজি দরে এবং আপেল কুল ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। 

ডিএই বান্দরবানের উপপরিচালক এমএম শাহ্ নেয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় অনাবৃষ্টি ও তীব্র খরার কারণে আম, লিচু, কুলসহ উদ্যান জাতীয় ফসলের ফুল ঝরে যায়। তখন ফলনে এর প্রভাব পড়ে। সব ফলন বা সব মৌসুমে সমান উৎপাদন হয় না, উৎপাদন ও আবাদের পরিমাণও বাড়ে-কমে।’ 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙ্গামাটি অঞ্চলের মৌসুমি ফলের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তিন পার্বত্য জেলায় ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমিতে কুল আবাদ হয়েছে, উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৮৮৬ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে ৩৪ হাজার ৮৭৬ টন উৎপাদন হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৮১ হেক্টর জমিতে ৩৫ হাজার ৩৯৯ টন উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৪১৯ হেক্টর জমিতে ২২ হাজার ৮২০ টন উৎপাদন হয়েছে। তবে ডিএইর ২০২২-২৩ অর্থবছরের মৌসুমি ফলের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তিন পার্বত্য জেলায় কুল চাষ কমে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন জেলায় ২ হাজার ৪৯৬ হেক্টর জমিতে ২০ হাজার ৫৪৬ টন কুল উৎপাদন হয়েছে। 

ডিএই রাঙ্গামাটির উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার জেলায় কুল উৎপাদন কিছুটা কমেছে। তাপমাত্রা ও বাগান পরিচর্যায় মনোযোগের অভাবে উৎপাদন কমছে। বিগত কয়েক বছরের উৎপাদন পরিসংখ্যা আমার জানা নেই। সেক্ষেত্রে আগের চেয়ে ফলন বেড়েছে না কমেছে; তা আপাতত বলতে পারছি না।’ 

ডিএই বান্দরবানের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) তৌফিক আহমেদ নূর বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ১ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয়েছে, উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৬ টন। চলতি বছরের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে এবারের পরিস্থিতি বোঝা যাবে।’

আরও