বান্দরবানের প্রধান দুই নদ-নদী সাঙ্গু ও মাতামুহুরী। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি নদী। অতিবৃষ্টির কারণে প্রতি বছরই বর্ষাকালে আগ্রাসী পাহাড়ি ঢল নামে। আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয় জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। ভাঙে নদীর পাড়। মূলত খরস্রোতা নদীর গতিপথে আঁকাবাঁকা স্থানগুলোয় এ ভাঙন দেখা দেয়। এরই মধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে তীরবর্তী বিভিন্ন লোকালয়ের অনেক বাড়িঘর ও ফসলি জমি। এতে বিপর্যয় নেমেছে নদীপারের বাসিন্দাদের আর্থসামাজিক অবস্থায়। জীবনের তাগিদে স্থানান্তর হচ্ছে অনেকেই।
সম্প্রতি সরজমিনে দেখা যায় বান্দরবান সদর ইউনিয়নের গোয়ালিয়াখোলা এলাকায় সাঙ্গু নদের পাড়ে কোনোরকমে টিকে আছে একটি বাড়ি। নদীতে বিলীন হওয়া যেন সময়ের অপেক্ষা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়িটি শাহজাহানের বাপের ভিটা নামে পরিচিত। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন শাহজাহানের ভাই সাহাবুদ্দিন। কথা হলে তার স্ত্রী রাশেদা আক্তার বণিক বার্তাকে জানান, গত জুলাইয়ের শেষের দিকে হওয়া প্রবল বর্ষণে তাদের আত্মীয় হাবিবের বাড়িটি এক রাতের মধ্যই নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এখন তারা অনেকটা নিরুপায় হয়েই বিপজ্জনক এ বাড়িতে বাস করছেন।
স্থানীয়রা জানান, গত বর্ষা মৌসুমে হাবিবের পাশাপাশি রফিকুল ইসলাম, সাইফুল, ওসমান, সাহেদ, শামসুল ইসলাম ও সেলিমের বাড়ি আগ্রাসী সাঙ্গুতে বিলীন হয়েছে। আর কয়েক বছরে নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়েছেন আরো অনেকেই।
সেলফোনে কথা হলে বাড়ি হারানো হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিন বছর আগেও আমাদের বাড়িটি নদীর পাড় থেকে বেশ দূরে ছিল। বাড়ি বিলীন হওয়ার দিনও পাড়ের বিস্তৃতি ছিল অন্তত ২৫ ফুট। ঘটনার দিন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছিল। এ সময় হঠাৎ পাড় ভাঙনের অস্বাভাবিক শব্দ শুনি। উঠে দেখি রান্নাঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই বাড়ির বাইরে চলে আসি। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার বাড়ি হেলে পড়ে। সকাল হওয়ার আগেই জায়গাসহ সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কোনো মালামালও নিতে পারিনি।’
গোয়ালিয়াখোলায় তিন বছর ধরে সাঙ্গুর ভাঙনের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। ভাঙনের কবলে পড়েছে এলাকার তিন সমাজের প্রায় ৪০০ পরিবারের একমাত্র কবরস্থানটিও। এরই মধ্যে দুই ভাগের এক ভাগ নদে বিলীন হয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে ভাঙন এলাকায় একটি সমীক্ষা চালায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ওই সমীক্ষায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য এলাকাকে ভাঙনপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কেবল ২০০ মিটারের কিছু বেশি অংশে ভাঙন রোধে কাজ করা হয়েছে, যা পর্যাপ্ত নয় বলে জানান সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার ও গোয়ালিয়াখোলার বাসিন্দা মো. শহিদুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে গোয়ালিয়াখোলার মতো সাঙ্গু নদের তীরবর্তী ভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে সদর, রুমা, থানচি উপজেলা এবং মাতামুহুরী নদীতীরবর্তী লামা, আলীকদম উপজেলায় অন্তত ২০টি লোকালয়ের সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে সাঙ্গু তীরবর্তী সদর উপজেলার ভরাখালী, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ও লাংগ্যেপাড়া; রুমা উপজেলার পাইলটপাড়া ও রুমা বাজার; থানচি উপজেলার থানচি বাজার, রেমাক্রিমুখ, হেডম্যানপাড়া, বড়মদক বাজার ও বলিপাড়া বেশি ভাঙনপ্রবণ এলাকা। অন্যদিকে মাতামুহুরী নদীতীরবর্তী আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা বাজার, পোয়ামুহুরী, সাবেরমিয়াপাড়া ও বটতলী মারমাপাড়া; লামা উপজেলার লামা বাজার, অংহ্লাপাড়া, মেরাখোলা, শীলেরতুয়া মারমাপাড়া, সাবেক বিলছড়ি এলাকা প্রতিনিয়তই ভাঙছে।
পাউবো বান্দরবান কার্যালয় সূত্র জানায়, গত আগস্টে হওয়া ভয়াবহ বন্যায় জেলার বিভিন্ন স্থানে নতুন করে নদীতীরে ভাঙন সৃষ্টি হয়। বন্যা-পরবর্তী সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ নতুন এলাকাগুলো এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রুমা উপজেলার পলিপাড়া, লামা উপজেলার গাইন্দ্যাপাড়া বমুর খাল, হাফেজপাড়া, গজালিয়া হেডম্যানপাড়া বমুর খাল, কালিংগ্যাবিল মারমাপাড়া, মংশৈপ্রুপাড়াসহ আরো কয়েকটি এলাকা রয়েছে।
জানতে চাইলে পাউবো বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেলার নদীতীর ভাঙনের স্থানগুলো প্রতিরক্ষায় প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। সেটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পপনা মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নোটিস দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে দুই নদীর নদী ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, কৃষিসহ সামগ্রিক খাতে উন্নয়ন ঘটবে।’
গত বন্যায় নদীতীরবর্তী ও জুমসহ প্রায় নয় হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। জানতে চাইলে সংস্থাটির উপপরিচালক এমএম শাহ্ নেয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যা ও নদীভাঙনে প্রায় ২৫ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। আগামীতেও এ প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। তবে প্রাকৃতিকভাবে নদীর গর্ভে বিলীন হওয়া জমি ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই।’