স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য নাটোরের তোকিয়া এলাকায় সাত বিঘা জমি কিনেছে রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি (আরএসটিইউ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকায় কেনা হলেও জমিটির নিবন্ধন করা হয়েছে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল আজিজের নামে, যা আইনগতভাবে অবৈধ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবও বেআইনিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন এ ট্রাস্টি। উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) একটি তদন্তে উঠে এসেছে আরএসটিইউর বিওটি চেয়ারম্যানের এসব অনিয়ম।
নাটোরের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আরএসটিইউ ২০১৩ সালে অনুমোদন পায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অননুমোদিত প্রোগ্রাম পরিচালনা ও অবৈধ সনদ দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এর মধ্যে অনেক অনিয়মে জড়িতদের তালিকায় খোদ বিওটির চেয়ারম্যানেরও নাম আসে। সে ধারাবাহিকতায় এবার সামনে এল বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি ও ব্যাংক হিসাব অবৈধভাবে নিজের নামে রাখার বিষয়টি।
জানা যায়, আরএসটিইউর সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত করতে গত বছরের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিদর্শনে যায় ইউজিসির একটি তদন্ত দল। এতে আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর। তদন্ত দলের সদস্য সচিব ছিলেন ইউজিসির সহকারী পরিচালক নূরী শাহরীন ইসলাম। সদস্য ছিলেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক শরিফুল ইসলাম। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত নভেম্বরে তারা একটি প্রতিবেদন জমা দেন। তদন্ত কমিটির সেই প্রতিবেদনে বিওটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল আজিজের অনিয়ম নিয়ে বলা হয়, স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি তিনি নিজের নামে কিনেছেন, যা সুস্পভাবে আইনের ব্যত্যয়। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৯(১) অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অন্যূন এক একর এবং অন্যান্য এলাকায় অন্যূন দুই একর নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত জমি থাকতে হবে।
হিসাব পরিচালন বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির ব্যাংক হিসাব পরিচালনাকারী বিওটির চেয়্যারম্যান অধ্যাপক আব্দুল আজিজ। সেটিও আইনানুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৪৪(২) ধারা অনুযায়ী, সাধারণ তহবিল পরিচালিত হবে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ও ট্রেজারারের যৌথ স্বাক্ষরে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি হতে হবে দায়মুক্ত। আইনের এ নির্দেশনা অনুযায়ী, জমি অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে নিবন্ধন থাকতে হবে। কেননা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে ব্যক্তির পরিবর্তন হয়। ফলে ট্রাস্টির নামে জমি কেনার বিষয়টি কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ হয়নি। এছাড়া ব্যাংক হিসাব কার নাম ও স্বাক্ষরে পরিচালিত হবে, সে বিষয়েও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গিয়ে যদিও আমরা তার ব্যত্যয় দেখতে পেয়েছি। আর্থিক ও প্রশাসনিক এ অনিয়মগুলো ছাড়াও সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশও খুঁজে পাইনি।’
অবকাঠামো দুর্বলতা তুলে ধরে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার কোনো পরিবেশ নেই। ক্যাম্পাস মোটেও শিক্ষাবান্ধব নয়। ক্লাসরুম, কমনরুম ও ওয়াশরুম কোনোটিই শিক্ষার্থীবান্ধব নয় এবং শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ সেখানে নেই। শ্রেণীকক্ষগুলোয় খুবই অপ্রতুল আলো। ক্রস বায়ু চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ভবনের ছাদে থাকায় গরমের সময় সেখানে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করা অত্যন্ত কঠিন। অপ্রতুল রয়েছে বইয়ের সংখ্যাও।
শিক্ষক সংকট নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিনটি অনুষদের অধীনে ১১টি বিভাগে পরিচালনা করা হচ্ছে ১৫টি প্রোগ্রামের শিক্ষা কার্যক্রম। তবে কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী, পর্যাপ্ত শিক্ষক ও ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ না থাকায় বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে নতুন শিক্ষার্থী বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ প্রোগ্রামে শুক্রবার-শনিবারভিত্তিক ক্লাস হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া হয় একসঙ্গে, যা উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে অন্তরায়। কিছু প্রোগ্রামে কোনো শিক্ষার্থীই নেই।
ইউজিসির ওই প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টির সংরক্ষিত তহবিলের বিষয়েও বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির সংরক্ষিত তহবিলের মূল কপির অনুলিপি, ব্যাংকের প্রত্যয়নপত্র ও সর্বশেষ ব্যাংক স্টেটমেন্টের সত্যায়িত কপি কমিটিকে দেখাতে পারেনি। এছাড়া সংরক্ষিত তহবিলের ইন্টারেস্ট সরকার ও কমিশনের অনুমতি ছাড়া তোলা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত তা পুনর্ভরণ করা হয়নি। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ১২ লাখ টাকার একটি ঋণ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রাস্টি বোর্ডের নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করেও বিওটি চেয়ারম্যানকে পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অবকাঠামোগত যেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ইউজিসি নির্দেশনা দিয়েছে, তা স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে পূরণ করা কঠিন। ব্যাংক হিসাব পরিচালনাকারী নির্ধারণের বিষয়টি দেখেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান স্যার। তবে আমি যতদূর জানি, স্থায়ী ক্যাম্পাসের জমি শুরুতে স্যারের নামে কেনা হলেও পরে তিনি তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে লিখে দিয়েছেন।’