কিছুদিন আগে আমি এখানে কর্তৃত্বের কণ্ঠস্বর ছিলাম। এখন আমি ফেরারির মতো ছুটছি, যার সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে জানিয়েছেন নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসের একজন প্রভাবশালী নেতা। ছদ্মনাম ব্যবহার করে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান তিনি। রোববারে এক প্রতিবেদনে এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাম্পাসের সাবেক ক্ষমতাশালী, রাজপথে আওয়ামী লীগের পেশিশক্তি হিসেবে পরিচিত এসব ছাত্র এখন উচ্ছেদ, প্রতিশোধ, এমনকি কারাবাসের মুখোমুখি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ দমনচেষ্টা এবং তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাদের আজ এ দশা।
ফাহমি বলছেন, ‘হাসিনাবিরোধী বিক্ষোভকালে জনগণের বিরুদ্ধে সরকারের প্রাণঘাতী দমন–পীড়নে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। বলেন, ‘আমার বোনেরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। আমিও মনে করতাম, দাবি সঠিক। কিন্তু আমি দলীয় বাধ্যবাধকতায় আটকা পড়েছিলাম।’
ফাহমি বলেন, হাসিনাবিরোধী বিক্ষোভকারীরা ঢাকা থেকে ১৭৩ কিলোমিটার দূরে নোয়াখালী জেলায় আমার পরিবারের বাড়ি ও কোল্ডস্টোরেজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোথায় আছি, তা না জানালে তারা আমার ছোট ভাইকে হাওয়া করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত তারা তেমন কিছু করেননি। যদিও তার ছোট ভাই যে মাদ্রাসায় পড়ে, সেখানে সে পীড়নের শিকার হয়েছে।
ছাত্রলীগে সম্পৃক্ততার কথা ফাহমি স্বীকার করে বলেন, ‘আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। রাজনীতি নিয়ে আমি খুব কমই চিন্তা করতাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল রাজনীতি এড়ানো যায় না। আপনি হয় যোগ দিয়েছেন, নয়তো আপনি ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।’
দুই বছর আগে ফাহমির বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তার মা, দুই অবিবাহিত বোন ও ছোট ভাইয়ের দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়ে। তিনি স্বীকার করেন, ছাত্রলীগের একজন নেতা হওয়াটা তার একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। আক্ষেপ করে ছাত্রলীগের এ নেতা বলেন, ‘পেছনে ফিরে তাকালে আমি দেখতে পাই যে আমি আমার পরিবারকে সমর্থন করার চেয়ে দলকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।’
তিনি তিক্তস্বরে বলেন, ‘আমি যে সালাম দিতাম এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনিয়োগ করেছিলাম আমাদের নেতাদের জন্য এবং দলীয় সমাবেশের আয়োজনে, এখন তা অর্থহীন মনে হচ্ছে।’
ফাহমি বলেন, ‘দল আমাদের তার রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু যখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন কোনো সুরক্ষা দেয়নি। হঠাৎ সরকার পতন হলো। ক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোটা আমার পক্ষে সেই সন্ধ্যায় সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। তারপরও দলের শীর্ষ নেতারা বা ছাত্রলীগের নেতারা কেউই আমার খোঁজ নেননি।’
ফাহমির শেষ বর্ষের পরীক্ষা চলছে। তিনি ক্লাসে যোগ দিতে পারেননি। কিংবা তাঁর ডিগ্রি শেষ করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে চেয়েছিলাম এবং জাতির সেবা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাম্পাসে পা রাখলে নানা গোলমেলে অভিযোগে আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কিংবা আরও খারাপ কিছু—আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হতে পারে।’
ফাহমি একাই এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি। আওয়ামী লীগের আনুমানিক হিসাবমতে, সারা দেশে দলসংশ্লিষ্ট অন্তত ৫০ হাজার ছাত্র এখন অচল হয়ে আছেন। তারা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রী শাহরিন আরিয়ানা। পরিবার বলেছে, ১৮ অক্টোবর তাকে ‘ভুয়া’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গিয়ে শাহরিন আটক হন। একই দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রলীগ নেতা সৈকত রায়হানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর মাহবুবর রহমান আল–জাজিরাকে বলেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতার সঙ্গে পরীক্ষায় বসতে রাজি হননি অন্য শিক্ষার্থীরা। কোনো ধরনের ‘মব জাস্টিস’ এড়াতে এ দুজনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল, অন্যথায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত।
২৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে এসে আরো দুই ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার হন। তারা হলেন—ফিন্যান্সের ছাত্র আবুল হাসান সাইদী ও নৃবিজ্ঞানের ছাত্র কাজী শিহাব উদ্দিন তৈমুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। সে অনুযায়ী তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বর্তমানে ভারতে আছেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যে নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি, সে জন্য তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, এ সরকার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দাবি করছে। অথচ তারা হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। তবে ড. ইউনূসের উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার আল-জাজিরাকে বলেন, নিয়মিত একাডেমিক কার্যক্রমে যোগদানের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই স্বাধীন, যদি না তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক অভিযোগ থাকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মাহবুবর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের আধিপত্যের সময় ক্যাম্পাসে সহিংসতা ছিল সাধারণ ঘটনা, নতুন বাংলাদেশে তার পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয়। সহিংসতার সম্মুখীন না হয়ে সব শিক্ষার্থী যাতে স্নাতক শেষ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করাই কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য। তবে তিনি উল্লেখ করেন, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত চলছে। কোনো শিক্ষার্থী দোষী বলে প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।