কৃষক বাবার ছেলে মো. তারেক (১৮) সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন খুব কম বয়সে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। দর্জির কাজ করতেন। থাকতেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী ১ নং রোড বিবির বাগিচা এলাকায়। গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে নিহত হন। যদিও পরিবারের সদস্যরা তা জানতেন না। প্রায় এক মাস খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যান তারা।
খোঁজাখুঁজির মধ্যেই গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেলের মর্গে তারেকের সন্ধানে আসেন তারা। সেখানে তখনো ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অবস্থায় পড়ে ছিল আন্দোলন চলাকালে নিহত নয়জনের মরদেহ। তাদের মধ্যে চেহারার অবয়ব, হাতের আংটি ও ঘড়ি দেখে একজনকে শনাক্ত করা হয় তারেক হিসেবে।
নিহত মো. তারেকের পিতার নাম মো. রিয়াজ। মায়ের নাম তাসনুর। বাড়ি ভোলা জেলার চরফ্যাশন থানার খোদেজাবাদ গ্রামে। ১ সেপ্টেম্বর দুপুরেই ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক মর্গ থেকে নিহতের বাবা মরদেহটি গ্রহণ করেন।
নিহত তারেকের বাবা রিয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো অছিলায় হোক আমার ছেলে মারা গেছে। ছেলের উপার্জন দিয়েই সংসার চলত। ছেলের জন্যই সংসারটা চালাতে পেরেছি। আমার আরো চার বাচ্চা আছে। বাড়ির বাইরে কোনো জমিজমাও নেই। সংসার চালানোর কেউ নেই। এ সংসারের দায় সরকারকেও নিতে হবে।’
নিহত তারেক গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশ নেন। দুপুর সাড়ে ১২টার সময় সর্বশেষ কথা হয় স্বজনদের সঙ্গে। এরপর তাকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। নিহতের ফুফাতো বোন তানিয়া আক্তার তার মরদেহ শনাক্ত ও গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘নিহত তারেক যাত্রাবাড়ী এলাকায় টেইলরের দোকানে কাজ করতেন। সরকার পতনের দিনসহ এর আগেও সাতদিন ধরে নিয়মিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার কথা জানিয়েছিল তারেক। তবে ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। সঙ্গেও কেউ ছিল না যে কী হয়েছে তা জানব। এতদিন ধরে কোথাও খুঁজে না পেয়ে মনে হলো মর্গে গিয়ে একবার খোঁজ নিই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে এসে ছবি দেখে কিছুটা মিল পেয়ে হাতের ঘড়ি, আংটি দেখে বুঝতে পারি এটিই আমাদের তারেক।’
পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট সর্বশেষ কথা হওয়ার পর তারেককে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। সে সময় পরিবারের লোকজন ধারণা করেছিলেন তার ফোন নষ্ট হয়েছে। আগেও এমন ফোন নষ্ট থাকায় সপ্তাহখানেক পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এরপর দুই-তিনদিন পার হলেও আর খোঁজ মিলছিল না তারেকের। স্বজনরা তার মেসে ও দর্জির দোকানে গেলেও কোনো খবর পাননি। পরে ডেমরা থানা থেকে শুরু করে গোটা যাত্রাবাড়ী তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়। শনির আখড়া, কেরানীগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ যেখানে যেখানে আত্মীয়স্বজন আছে; সব জায়গায়ই সন্ধান করা হয়। কিন্তু তারেকের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এভাবে পার হয়ে যায় প্রায় এক মাস। ফুফাতো বোনের পরামর্শে ঢামেক মর্গে আসেন তারেকের বাবা। মর্গে মরদেহের ছবি দেখে প্রথমে শনাক্ত করেন। পরে সামনাসামনি দেখে মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করেন তারা।
তারা জানান, নিহতের বুকে বড় ছিদ্র দেখতে পেয়েছেন তারা। গলার নিচ দিয়ে গুলি ঢুকে বের হয়ে গেছে। বুকটাও ঝাঁজরা ছিল। চোখ বের হয়ে গেছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া মরদেহ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানানো হয় তাদের। এরপর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করতে গেলে সেখানে সব বন্ধ থাকায় পাঠানো হয় ডেমরা থানায়। ডেমরা থানায়ও কোনো মামলা নেয়নি।
তারেকের ফুফাতো বোন তানিয়া আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থানার ওসি হাসতে হাসতে বলেছেন, “দেখেন আমাদের এভাবে মারছেন! রোডেও পুলিশ নাই, সব বন্ধ। দেখেন পুলিশ ছাড়া কেমনে চলে! এখন বোঝেন”!’
২ সেপ্টেম্বর পুলিশ মামলা না নিলে সেদিন রাত ৮টার দিকে ডেমরা থানা থেকে বাসায় ফিরে যান তারেকের স্বজনরা। পরের দিন ৩ সেপ্টেম্বর ঢাবির টিএসসিতে এসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের জানালে তাদের সহায়তায় ঢামেক মর্গ থেকে মরদেহ বুঝে পান তারেকের স্বজনরা।