ডিমের দাম এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চে। বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম উঠেছে সর্বোচ্চ ১৭০ টাকায়। দেশী মুরগির ডিম কোথাও কোথাও প্রতি ডজন ২২০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। ডিমের দামের বর্তমান পরিস্থিতির পেছেন মাছের মূল্যবৃদ্ধি বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, মাছের দাম বাড়ায় আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য বিকল্প পণ্য হিসেবে জনসাধারণের মধ্যে ডিমের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। চাহিদা বাড়লেও গত কয়েক মাসের প্রতিবেশগত দুর্যোগের কারণে বাজারে ডিমের সরবরাহ বাড়ানো যায়নি। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত কয়েক ধাপে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে পোলট্রি খামারগুলোয় হিটস্ট্রোকে অনেক মুরগি মারা যায়। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানের সাম্প্রতিক বন্যার কারণেও ডিম ও মুরগির সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি ডজন লাল ডিম বা ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৭০ টাকায়। সাদা ডিম ১৫০-১৬০, দেশী ডিম ২১০-২২০ ও হাঁসের ডিম ২০০-২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারের সিংহভাগ ডিমই ফার্মের। মহল্লার দোকানগুলোয় প্রতি পিস ডিম ১৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, এক সপ্তাহ আগেও বাজারে ফার্মের ডিমের দাম ছিল প্রতি ডজন ১৪০-১৫০ টাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে মাছের মূল্যবৃদ্ধিকে বাজারে ডিমের দাম বাড়ার বড় অনুঘটক হিসেবে দেখছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে মাছ, ডিম ও মুরগি একে অপরের বিকল্প পণ্য হিসেবে কাজ করে। অতীতেও দেখা গেছে, এর কোনো একটির দাম বাড়লে অন্যগুলোর দামেও প্রভাব পড়ে। গত কয়েক মাসে শুধু রুই ও কাতলা মাছের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ। আবার দরিদ্রের সুলভ আমিষের উৎস হিসেবে পরিচিত তেলাপিয়া ও পাঙাশের দামও এখন নাগালের বাইরে। এতে এক শ্রেণীর ভোক্তা এখন মাছের পরিবর্তে ডিম ও মুরগিতে ঝুঁকছেন বেশি। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডিম-মুরগির দামও এখন বাড়তির দিকে। ডিমের দামের ঊর্ধ্বমুখিতাকে আরো জোরালো করে তুলেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটার বিষয়টি।
এর আগে গত বছরের আগস্টেও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরবরাহ সংকটের অজুহাতে হুট করে বেড়ে যায় মুরগি ও ডিমের দাম। তখন তেলাপিয়া ও পাঙাশের চাহিদা বেড়ে যেতে দেখা যায়। সে সময়ও সপ্তাহের ব্যবধানে তেলাপিয়া ও পাঙাশের কেজি ৫০-৬০ টাকা বেড়ে যেতে দেখা গেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডিম, মুরগি ও তেলাপিয়া-পাঙাশ প্রোটিনের মধ্যে এ তিনটি উৎস কিছুটা সস্তায় পাওয়া যায়। স্বল্প আয়ের মানুষ এ তিনটি থেকেই তাদের আমিষের চাহিদা পূরণ করে। এগুলো একটি আরেকটির পরিপূরক। ফলে মাছ ও মাংসের দাম যদি বেশি বেড়ে যায়, তাহলে ডিমের চাহিদাও বেড়ে যাবে এটা স্বাভাবিক। এখন ডিমের দামও বেড়েছে। যেমন খাসির মাংসের দাম বাড়লে গরুর মাংসের দামও বাড়বে। কারণ একটি আরেকটির পরিপূরক। আবার দাম কমলে সবগুলোর একসঙ্গেই কমবে। যদি একটির সরবরাহ বেড়ে যায় এবং একটির দাম কমে যায়, তাহলে অন্যগুলোও কমে যাবে।’
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, রুই ও কাতলা প্রতি কেজি আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৪৫০ টাকা। আর তেলাপিয়া ২২০-২৫০ এবং পাঙাশ ২১০-২৩০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। এর পাশাপাশি অন্য মাছের দামও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গত কয়েক মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
রাজধানীতে ডিমের সবচেয়ে বড় আড়ত তেজগাঁওয়ে। তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত কিছুদিন ধরে ডিমের সরবরাহ কম। আবার চাহিদাও বেড়েছে। এর কয়েকটি কারণ হতে পারে। গত কয়েকদিনে মাছের দাম অনেক বেশি বেড়েছে। এখন মানুষ মাছ না কিনে ডিম খাচ্ছেন। আবার গত কয়েক মাসে তাপপ্রবাহের কারণে খামারগুলোয় অনেক মুরগি মারা গেছে। অনেক খামারির খামার ফাঁকা হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি এবং বন্যায় আরেক দফা সংকট তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে ডিমের দাম বেশি। আমরা বেশি দামে কিনছি। এ কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
বাজারে এখন মুরগির দামও বাড়তে দেখা যাচ্ছে। রাজধানীর বাজারগুলোয় ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা। কিছুদিন আগে বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা প্রতি কেজি। এছাড়া বর্তমানে সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ২৯০-৩০০ টাকা, পাকিস্তানি কক ৩০০-৩১০ ও লেয়ার মুরগি প্রতি কেজি ৩২০-৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় একটি মেসে থাকেন স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. তৌসিফুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মেসে সাধারণত আমরা মুরগি ও মাছ খাই। কিন্তু গত কয়েক মাসে সবকিছুর দাম যেভাবে বেড়েছে আমরা প্রায়ই এখন সবজি, ভর্তা বা ডিম খাচ্ছি। তবুও খরচ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আগে মিল রেট ৪৫ টাকা হলে এখন ৬০ টাকা পড়ছে। মাছের দাম এখন অনেক বেশি। মুরগির দাম কিছুটা কম ছিল। সেটা আনতাম। এখন ডিম-মুরগি দুটোর দামই বেড়েছে। যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে, আমরা খাব কী?’
এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক ধাপে তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দেয়। ওই সময় বিভিন্ন স্থানে তীব্র গরমে হিটস্ট্রোকে প্রচুর মুরগি মারা গেছে বলে জানিয়েছেন খামারিরা। ফেনীর খামারি মো. আরিফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে আমাদের অনেক মুরগি মারা গেছে। আশপাশে অনেককে দেখেছি লোকসানে পড়ে খামার ছেড়ে দিতে। এ কারণে বাজারে সরবরাহ কম। আমরা অল্প কিছু মানুষ এখনো উৎপাদন ধরে রাখতে পেরেছি।’
সরবরাহকে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির বড় অনুঘটক হিসেবে দেখছেন কাজী ফার্মস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান। ডিমের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যখন উৎপাদন বেশি হয় বা সরবরাহ বেশি হয় তখন দাম কমে যাচ্ছে। আবার যখন সরবরাহ কমে আসছে তখন দাম বেড়ে যাচ্ছে।’
বন্যার কারণে সামনের দিনগুলোয় মুরগির দাম বাড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘খামারির মুরগি উৎপাদন করতে ১৬৫-১৭০ টাকা গুনতে হয়। কিন্তু তা বিক্রি করে ১৩০-১৪০ টাকা। এ কারণে অনেক খামারি লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন বন্যায় আরো অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে সামনে মুরগি ও ডিমের দাম আরো বাড়তে পারে।’
সরকারি তদারকি না থাকায় পোলট্রি শিল্পে করপোরেটদের আধিপত্য বিস্তারের খেসারত জনগণকে দিতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করপোরেট কোম্পানিগুলোর দাদন ব্যবসার কাছে খামারিরা জিম্মি হয়ে আছেন। তারা মূল্যবৃদ্ধি বা হ্রাসের মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদের পথে বসিয়ে দিচ্ছেন। আবার বৈশ্বিকভাবে খাদ্য উপকরণের দাম কমলেও কোম্পানিগুলো পোলট্রি খাদ্যের দাম কমাচ্ছে না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সব জানে। তাদের কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে গরিব মানুষ কী করবে? মাছের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেকেই ডিম ও মুরগি দিয়ে আমিষের চাহিদা পূরণ করে। এটি একটি কারণ। আবার ব্যবসায়ীরাও এখন বেপরোয়া। তারা সুযোগ খোঁজেন কখন দাম বাড়ানো যায়। এর জন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণও লাগে না। যারা কারসাজি করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক বছর আগেই আমরা ডিম ও মুরগির বাজারে অস্থিরতার কারণ বের করেছি, মামলাও করেছি। আমাদের প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। ডিমের দাম এখন বেশি বলা হচ্ছে। কিন্তু এর উৎপাদন খরচ কত তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে জানাতে হবে। কিন্তু কোনো কিছুই তারা জানাচ্ছে না। আমরা আগেই ডিটেইলস কাজ করেছি। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা আজ গভীর রাত থেকেই অভিযান শুরু করব।’