দেশে কর্মজীবীদের বড় অংশই কাজ করছেন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবিহীন অনানুষ্ঠানিক খাতে বা ইনফরমাল চাকরিতে। সাধারণত যেসব চাকরিতে আইনি সুরক্ষা পাওয়ার মতো সুযোগ ও কাঠামো থাকে না; সেগুলোকেই এ খাতের অন্তর্ভুক্ত ধরে নেয়া হয়। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বিশ্বে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
তালিকা অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মাদাগাস্কার। দেশটির মোট কর্মসংস্থানের ৯৬ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সুদান ও নাইজেরিয়া। সুদানে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ ও নাইজেরিয়ায় ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমশক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে লাওস, জাম্বিয়া ও বলিভিয়া। দেশগুলোয় অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত রয়েছে মোট শ্রমশক্তির যথাক্রমে ৯০ দশমিক ৫, ৮৫ দশমিক ৬ ও ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গত কয়েক বছরে শিক্ষার হার বেড়েছে। উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যাও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বাড়েনি। বিশেষত বেসরকারি খাতে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে না। তরুণদের বড় অংশ এখন সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছে। সৃষ্টি হচ্ছে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক আন্দোলনও।
বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) একেএম ফাহিম মাশরুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের অর্থনীতি এখনো এসএমই খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মীর সংখ্যা বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তবে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। আগে দেখা যেত শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি সরকারি চাকরির চেষ্টা করত। কিন্তু এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সবারই লক্ষ্য সরকারি চাকরি। কোটা আন্দোলনের মতো আন্দোলনেও বিষয়টির প্রভাব রয়েছে।’
বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের ৬০ দশমিক ৬ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্নদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতের হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের এ ঝোঁকের প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রেও। সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনায় অনেক কম যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরিতেও আবেদন ও যোগদান করছেন তরুণরা।
গত ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ জন ওয়েম্যান নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চতুর্থ শ্রেণীর (১৯তম গ্রেড) ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এছাড়া রেললাইনের নাট-বল্টু টাইট দেয়াসহ ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও তারাই করে থাকেন। কায়িক পরিশ্রমনির্ভর পদটিতে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে এসএসসি বা সমমান। তবে সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ওয়েম্যান হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স পাস।
শুধু রেলওয়ে নয়, একই ঘটনা ঘটছে এ ধরনের অন্যান্য সরকারি চাকরিতেও। আবেদনকারীরা বলছেন, বেসরকারি চাকরিতে অনিশ্চয়তার কারণেও তারা নিম্নপর্যায়ের পদে হলেও সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে চাচ্ছেন। এমনই এক শিক্ষার্থী শামীম ইসলাম (ছদ্মনাম)। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি একই বিশ্বিবিদ্যালয়ে ১৬তম গ্রেডের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার টাইপিস্ট পদে যোগদান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পদটিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এইচএসসি পাস।
শামীম ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান। কিন্তু এখনো দেশের বেসরকারি বেশির ভাগ চাকরিতে নিশ্চয়তা নেই। নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট, পেনশনসহ অন্যান্য ভাতা এবং শ্রম আইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। ফলে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্যই সরকারি চাকরি বেছে নেয়া।’
বাংলাদেশের বিগত দুই শ্রমশক্তি জরিপ তুলনা করে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দেশে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালে দেশে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০২২ সালে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। অপরদিকে এ সময়ে উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেড়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। ২০১৬-১৭ সালে উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশে।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে. মুজেরি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশীয় ও বিশ্ববাজারের উপযুক্ত শ্রমশক্তি প্রয়োজন। এজন্য বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমেই বেশির ভাগ কর্মসংস্থান হয়। আর শ্রমঘন খাতে জোর দিতে হবে, যাতে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান তৈরি হয়।’
ড্যানিশ ট্রেড ইউনিয়ন ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির ‘লেবার মার্কেট প্রোফাইল: বাংলাদেশ ২০২৪-২৫’ প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের অনিশ্চয়তাকে শ্রমবাজারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত ১২ বছরে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ এবং দেশে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ব্যক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান কমলেও গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের কর্মসংস্থান বাড়ছে। এতে আরো বলা হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা চাকরির চুক্তি, মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক বীমাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পান না। মজুরির দিক থেকে তারা প্রায় ৩৫ শতাংশ কম মজুরি পান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি আরদাশির কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো এলডিসিভুক্ত দেশের তালিকায় আছে। সে হিসেবে আমাদের আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান খুব কম, এমনটা বলা যাবে না। সরকার সেবা খাতে কর্মসংস্থান বাড়াচ্ছে। বেসরকারি খাতও বড় হচ্ছে। তরুণদের কর্মদক্ষ করে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে এখানে একটি বিষয় হলো অন্যান্য দেশে এমন অনেক পেশাও বেতন ও সুযোগ-সুবিধার জন্য আনুষ্ঠানিক খাতের অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতের অন্তর্ভুক্ত। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। আমরা সবাই চাই সন্তান ডেস্ক জব করুক। এ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ডেস্ক জব ছাড়া অন্যান্য চাকরিও যে সম্মানজনক, সেটি বুঝতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কর্মসংস্থান বাড়াতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে। এজন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পে গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমঘন শিল্পের বিকাশে প্রয়োজনে ঋণ সুবিধা দিতে হবে। স্টার্টআপ ক্যাপিটাল বাড়াতে হবে। আউটসোর্সিং বাড়াতে ফ্রিল্যান্সার তৈরি করতে হবে। প্রবৃদ্ধি হতে থাকলে কর্মসংস্থান তৈরি হয়। যদিও উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর প্রবৃদ্ধি হলে কর্মসংস্থান কম হয়।’