সিলেটে পাহাড়ি টিলা কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে ঘরবাড়ি

সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভূতাত্ত্বিক পাহাড়ি অঞ্চল। ছোট-বড় পাহাড়ি টিলা এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রেখেছে।

সিলেটের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভূতাত্ত্বিক পাহাড়ি অঞ্চল। ছোট-বড় পাহাড়ি টিলা এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রেখেছে। তবে জেলার সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের হর্ণি এলাকায় অবাধে কাটা হচ্ছে পাহাড়িটিলা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, হর্ণি বাইরাখেল এলাকার বেশির ভাগ পাহাড় টিলা খাস খতিয়ানভুক্ত। তার পরও প্রভাবশালীরা এসব টিলা দখল করে রেখেছেন। অনেকেই প্রয়োজনমতো কেটে নিচ্ছেন। দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। এখন যে টিলাগুলো অবশিষ্ট রয়েছে, তা বিপন্ন হয়ে গেলে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু লালাখাল হর্ণি এলাকা নয়, পুরো উপজেলায় গোপনে, কোথাও প্রকাশ্যে চলে পাহাড় টিলা কাটা। এর আগে হরিপুর প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ এলাকায় অবাধে চলে লালমাটির টিলা কাটা। বাড়িঘর নির্মাণের কথা বলে ৫০-৬০ ফুট উঁচু টিলা কেটে মাটির শ্রেণী পরিবর্তন করে সমতল করা হয়। এরপর পাহাড় ও টিলার মাটি বিক্রি করা হয়। এরই মধ্যে ওই এলাকার কয়েকটি পাহাড় কেটে সমতলে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে লোক দেখানো দু-একটি অভিযান পরিচালনা করা হলেও বাস্তবে তার প্রভাব পড়েনি। এখন গোপনে চলে পাহাড় কাটা।

অভিযোগ রয়েছে, জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ এ ব্যাপারে নীরব। এতদিন আওয়ামী লীগ নেতারা পাহাড় কাটায় জড়িত থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে নতুন নতুন চক্র এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা এ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কাটা বা মোচন করতে পারবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সিলেটের ছয় উপজেলায় পাহাড় কাটা রোধে ২০১১ সালে উচ্চ আদালতে একটি মামলা করা হয় বেলার পক্ষ থেকে। সদর উপজেলা, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর জন্য রিট করা হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১২ সালের ১ মার্চ পাহাড় টিলা কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত রায় দেন। এ আইনের মাধ্যমে অপরাধ দমনে জরুরি প্রয়োজনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারবেন। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। বাস্তবে সংশ্লিস্ট দপ্তরের উদাসীনতায় আইন কার্যকর হচ্ছে না।’

সম্প্রতি জৈন্তাপুর উপজেলার যে এলাকায় টিলা কাটা হচ্ছে, সে এলাকার নাম লালাখাল হর্ণি বাইরাখেল। এ বিষয়ে নিজপাট ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তবে কারা টিলা কাটছে তাদের বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি তিনি। সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঘর নির্মাণের জন্য হয়তো অনেকে টিলা কাটছেন। তবে বিষয়টি আমার জানা নেই।’

পরিবেশবিদ আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, ‘সিলেটের উত্তর- পূর্বাঞ্চল ভূ-তাত্ত্বিক পাহাড়ি অঞ্চল। উন্নয়নের কথা বলে এরই মধ্যে পাহাড় টিলা ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক উন্নয়নকাজে ১৯৯৬ সালে পাহাড় ও টিলার বিশাল অংশ বিলীন করে দেয়া হয়। বর্তমানে যে টিলাগুলো রয়েছে তা বিপন্ন হয়ে গেলে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়বে। যে সরকারই আসুক পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না। এজন্য প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ। না হয় একদিন আমরা বড় রকমের বিপর্যয়ে পড়তে পারি।’

এ ব্যাপারে জৈন্তাপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, ‘পাহাড়ি টিলা কাটার খবর পেলে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। হর্ণি এলাকায় টিলা কাটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সিলেট বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘পাহাড় কাটার কোনো সুযোগ নেই। পরিবেশ উপদেষ্টার একটি নির্দেশনা এসেছে। আমরা পুলিশের সহযোগিতা পেলে অবশ্যই অভিযানে নামব। জৈন্তাপুর এলাকায় আমরা নজরদারি বাড়াব। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ 

আরও