দেশের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৫টি আসনের বিপরীতে ভর্তি হয় ৯৮ হাজার ৪৬ শিক্ষার্থী। সে অনুযায়ী ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ আসনই ফাঁকা রয়ে যায়। কোনো কোনো কোর্সে আবার ফাঁকা আসনের হার ৯০ শতাংশ। বৃত্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেশির ভাগই চাকরি না পাওয়ায় বছর বছর শিক্ষার্থী কমছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতেও আরো ২৩ জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।
জনসংখ্যাকে দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদে রূপান্তর ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্প্রসারণকে লক্ষ্য রেখে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। যদিও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম না থাকা, শিক্ষক সংকটসহ নানা সংকট সমাধান না করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুধুই দৃশ্যমান উন্নয়ন। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির যে লক্ষ্য তা থেকে দূরে সরে গিয়ে বেকার তৈরির নতুন আয়োজন কেবল।
‘২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন’ শীর্ষক এ প্রকল্পে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৬৯১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যদিও পরে এটি সংশোধন করে ৩ হাজার ৬৫১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা করা হয়। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে এ প্রকল্প কতটুকু সফলতা পাবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। শুরুতে এ প্রকল্পের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০১৮ সালে অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, নোয়াখালী, নাটোর, জয়পুরহাট, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নড়াইল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, নেত্রকোনা ও জামালপুর জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশে-বিদেশে চাকরির বাজার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালুর মাধ্যমে ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, ফ্যাশন ডিজাইন, সিরামিক, সিভিল, লেদার, অটোমোবাইল, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ফিশারিজ, শিপ বিল্ডিং, প্লাস্টিক অ্যান্ড পলিমার, রিনিউয়েবল অ্যান্ড গ্রিন এনার্জি, ফিল্ম মেকিং অ্যান্ড অ্যানিমেশন, ফুড, এগ্রিকালচার ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ডিজাইন, ফার্নিচার, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, সার্ভেয়িং, পাওয়ার, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন, লাইভস্টক, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, ওশানোগ্রাফিক, মেরিন, ইলেকট্রনিকস, মেকাট্রনিকস ও এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স টেকনোলজিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়া হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর ভর্তির সুযোগ পাবে ৯ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী। যদিও বাস্তবতা বলছে, পুরনো কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোই শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। তাই নতুন এ প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা কাজে আসবে তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩৪টি ডিগ্রির অধীনে ৩৪৬টি টেকনোলজি বা ট্রেড কিংবা স্পেশালাইজেশনে (বিভাগ) শিক্ষার্থী ভর্তি করছে সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এসব বিভাগে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন ছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৫টি। এর বিপরীতে ভর্তি হয় ৯৮ হাজার ৪৬ শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষাবর্ষে ৫৬ হাজার ৮৪৯টি আসনই ফাঁকা ছিল।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম বণিক বার্তা বলেন, ‘এখানে যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বা কারিগরি শিক্ষার যেসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সেগুলোয় কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা দেয়া হচ্ছে না। কর্মজগতের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ থাকে না। এটি তৈরি করা প্রয়োজন। লেখাপড়া শেষে ডিগ্রিধারীরা কোথায় যোগদান করবেন, তার কোনো অ্যালায়েন্স হয় না। এসব নির্ধারণ জরুরি। কর্মের নিশ্চয়তা দেয়া গেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ বাড়বে।’
দেশে কর্মক্ষম মানুষ থাকলেও দক্ষতা নেই উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দক্ষ মানুষ তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। কিন্তু পরিকল্পনাহীনভাবে এগিয়ে গেলে তো আর হবে না। চাকরি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের একটা লিয়াজোঁ করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামেও পরিবর্তন আনতে হবে। কর্মসংস্থানমুখী কারিকুলাম করতে পারলে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।’
২৩ জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রকল্পটি পরিকল্পনা বিভাগের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পর্যবেক্ষণ করেছে। চলতি বছর প্রকল্পটির বিস্তারিত মূল্যায়ন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে উঠে এসেছে, প্রকল্প নেয়ার পর থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও ড্রইং, ডিজাইন ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করা যায়নি। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে সাতটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জন্য এখনো জমির সংস্থান করা যায়নি, যা প্রকল্পের বড় ঝুঁকি হিসেবে আইএমইডির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
কারিগরি শিক্ষা যেভাবে এগোনো দরকার সেভাবে হচ্ছে না বলে মনে করেন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ নিজেই। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘করোনার কারণে পুরো বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত সপ্তাহেও জার্মানির সঙ্গে আমরা চুক্তি করেছি। তারা কারিকুলাম আপডেট করে দেবে। আধুনিক কারিকুলাম খুব জরুরি। শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যথাযথ সংযোগটা হচ্ছে না। এবার আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করব, যাতে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযোগটা হয়। আর সেটা করা গেলে কারিগরি থেকে পাস করে প্রত্যাশামতো চাকরি না পাওয়ার সংকট থাকবে না। এছাড়া শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে পারলে প্রশিক্ষণের মান বাড়বে। সংকটও কিছুটা কেটে যাবে।’