বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক

এক দশকে শতকোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে আটটি

দেশে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রতিষ্ঠা করা হয় বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক। ২০১৪ সালে যাত্রার পর দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ এ পার্কে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে ৮২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে কেবল আটটি। দক্ষ জনশক্তির অভাব ও পর্যাপ্ত ইকোসিস্টেম গড়ে না ওঠায় রাজধানী থেকে

দেশে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রতিষ্ঠা করা হয় বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক। ২০১৪ সালে যাত্রার পর দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ এ পার্কে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে ৮২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে কেবল আটটি। দক্ষ জনশক্তির অভাব ও পর্যাপ্ত ইকোসিস্টেম গড়ে না ওঠায় রাজধানী থেকে কিছুটা দূরের পার্কটি নিয়ে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলোর মধ্যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। 

বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের (বিএইচটিপিএ) একটি সূত্র বলছে, কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগকারী সবার তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে বারবার এ বিষয়ে তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। সুনির্দিষ্ট করে বিনিয়োগ তথ্য রয়েছে মাত্র ৩১টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে আইটি হাব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ৫৫ লাখ থেকে ৪৯ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান ১৯টি। এছাড়া চারটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ৫০ থেকে ৯৯ কোটি টাকা পর্যন্ত।

বিএইচটিপিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যাত্রার পর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে কেবল আটটি প্রকল্প থেকে। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বেস্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, স্মার্ট হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সামিট টেকনোপলিস লিমিটেড, আল আমিন অ্যান্ড ব্রাদার্স, এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ফেয়ার টেকনোলজিস লিমিটেড। সবচেয়ে বেশি ১২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ওয়ালটন গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৯ হাজার ৯২০ কোটি ও ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড লগ্নি করেছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বাইরে বেস্ট টাইকুনের বিনিয়োগ ৪১৪ কোটি ও এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজের ২০০ কোটি টাকা। স্মার্ট হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার ডলার। অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ১১১ টাকা ধরে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১২৩ কোটি টাকা। বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠান ১০০ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করেছে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে।

জানতে চাইলে স্মার্ট টেকনোলজিসের (বিডি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জহিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেশকিছু কারণেই হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগ আসছে না। এর মধ্যে অন্যতম ঢাকা থেকে এর দূরত্ব। হিসাব করলে রাজধানী থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে এ পার্কের অবস্থান। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলেও ট্রেন ধরার জন্য প্রথমে কমলাপুর যেতে হয়। তাছাড়া প্রযুক্তি খাতে যারা কাজ করেন তারা সবসময় উন্নত ও আধুনিক মানের বাসস্থান খোঁজেন। কিন্তু পার্ক এলাকায় ভালো বাসস্থান গড়ে ওঠেনি। কেউ ঢাকায় থেকে কাজ করতে চাইলেও সম্ভব হয় না। এখানে ইকোসিস্টেমও গড়ে ওঠেনি। আমরা আমাদের কর্মীদের কোথায় রাখব, তা নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়। এসব কারণেই এখানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসছে না।’ 

চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে ভারী যন্ত্রপাতি খালাসের পর ঢাকায় নিতে বড় ধরনের ব্যয় বহন করতে হয় বলে চট্টগ্রামে বড় বিনিয়োগ করেছে স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি)। জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের কারখানাটিকে শতভাগ রফতানিমুখী পণ্যের জন্য গড়ে তুলেছি। সেখান থেকে নিয়মিত রফতানিও হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে এখনো কাজই শেষ করতে পারিনি।’

সরকার ২০১১ সালে কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্ক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এরপর ভূমি উন্নয়ন, কানেক্টিভিটি স্থাপন, স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হয় ২০১৩ সাল থেকে। এর পর থেকে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পেলেও বেশকিছু আলোর মুখ দেখেনি। কিছু বিদেশী বিনিয়োগ এসেও ফিরে গেছে বলে জানায় পার্ক কর্তৃপক্ষ। ৩৫৫ একর জমির ওপর ৬৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পার্কটিতে এখন পর্যন্ত ৮২টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে চার হাজার লোকের। একই সঙ্গে ১২টি স্টার্টআপ কোম্পানিকে কো-ওয়ার্কিং স্পেস বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। 

পার্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বমানের বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে দেশী-বিদেশী তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে হাই-টেক পার্ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আইসিটি পেশাজীবীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা। তবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না আসা ও অবকাঠামোগত সংকটের কারণে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়নি। যদিও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন তা মানতে নারাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একটি খাতের উন্নয়ন করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। আমাদের তো মাত্র এক দশক পার হয়েছে। বিনিয়োগ এখনো আসছে। আর বিনিয়োগের একটি বৈশ্বিক বিষয় থাকে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষণ করেন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। যখন বুঝতে পারেন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তখন তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হন। আগামীতে আমাদের বিনিয়োগ আরো বাড়বে।’ 

প্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে হলে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। তবে দেশে এখনো সেভাবে দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠেনি। ফলে বিনিয়োগ এলেও তা কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করেন সচিব সামসুল আরেফিন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিতে আমরা দক্ষ হচ্ছি। ভারত, চীনসহ যারা প্রযুক্তিতে আগে থেকে এগিয়ে ছিল তারা ভালো করছে। এটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। আগামীতে আমরা আরো ভালো করব। আশা করছি, খুব দ্রুত আমরা উন্নতি করব।’ 

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাই-টেক পার্কের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হার্ডওয়্যার সামগ্রী দেশে নেই। আমদানির মাধ্যমে এর চাহিদা পূরণ করতে হয়। ফলে বিনিয়োগ করলেও দেশে ডলার সংকট থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারছে না। নতুন করে তাই বিনিয়োগকারীরা পার্কটির প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না। 

বিএইচটিপিএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিএসএম জাফর উল্লাহ্ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পার্কের আংশিক মৌলিক অবকাঠামো প্রস্তুত করতে আমাদের ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এসব অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃসংযোগ সড়ক, স্ট্রিট লাইট, অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক পোল, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন স্থাপন ইত্যাদি। বর্তমানে আরেকটি চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে মৌলিক অবকাঠামোর নির্মাণকাজ চলছে। এরই মধ্যে আমরা ছোট-বড় ৮৩টি প্রতিষ্ঠানকে জমি ও স্পেস বরাদ্দ দিয়েছি।’

বড় বিনিয়োগ না আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এর কারণ কোম্পানিগুলোর এসকেডি (সেমি নকড ডাউন) মডেলের উৎপাদন কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে সিকেডি (কমপ্লিট নকড ডাউন) মডেলে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করবে তারা। আশা করছি তারা পুঁজি বাড়িয়ে বড় বিনিয়োগের দিকে অগ্রসর হবে। এ সিটিতে আগামীতে ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করবে বরাদ্দপ্রাপ্ত এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচটি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগের জন্য হাই-টেক পার্ক পরিদর্শন করেছে এবং আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কাজেই বড় বিনিয়োগ আসছে না বিষয়টি এমন নয়।’

আরও