গবেষণার প্রধান লক্ষ্যই হলো নতুন জ্ঞান সৃজন। বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবিত জ্ঞান, প্রযুক্তি ও পণ্যের স্বত্ব সংরক্ষণে ‘পেটেন্ট’ গ্রহণ করতে হয় গবেষকদের। যদিও বাংলাদেশের গবেষণা খাতে পেটেন্ট গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। প্রতি বছরই বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন জার্নালে বাংলাদেশী গবেষকদের কয়েক হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। যদিও প্রকাশনার বিপরীতে পেটেন্ট গ্রহণ বা প্রাপ্তির হার খুবই নগণ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণার ক্ষেত্রে পেটেন্টযোগ্য বিষয় বা পণ্য নির্বাচন না করা, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় পেটেন্ট প্রাপ্তির নির্দেশনা অনুসরণের অভাব, পেটেন্ট পাওয়ার পর বাজারজাতের উদ্যোগের অভাব, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশীয় গবেষণার ভাবমূর্তি গড়ে না ওঠা, গবেষকদের অসচেতনতা, পেটেন্ট লাভে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে দেশের গবেষকদের মধ্যে পেটেন্ট গ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না।
দেশের পেটেন্ট খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। সেখানে গত কয়েক বছরে বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে দেশের গবেষকদের প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ও পেটেন্ট প্রাপ্তির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণার ভিত্তিতে প্রণীত ‘পেটেন্ট ইকোসিস্টেম ইন বাংলাদেশ: কারেন্ট স্ট্যাটাস, চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড প্রসপেক্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি হেলিয়ন জার্নাল অনলাইনে ‘প্রি-প্রিন্ট’ হিসেবে প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে দেয়া তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশীয় গবেষকদের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ১২ হাজার ৬৪৮। ওই বছর অনুমোদনপ্রাপ্ত দেশীয় পেটেন্টের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯। অর্থাৎ ওই বছর দেশীয় গবেষকদের পেটেন্ট ও পাবলিকেশনের অনুপাত ছিল ১:৪৩৬। যদিও একই বছর পাশের দেশ ভারতের গবেষকদের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪২৯। ওই বছর ভারতীয়রা পেটেন্ট পেয়েছেন ১৪ হাজার ৬১৩টি। পেটেন্ট-পাবলিকেশনের আনুপাতিক হার দাঁড়ায় ১:১৬.২৫। চীনের গবেষকদের ৮ লাখ ৬০ হাজার ১২টি গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়। দেশটির গবেষকদের পেটেন্ট সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৯। অর্থাৎ দেশটির পেটেন্ট-পাবলিকেশন অনুপাত দাঁড়ায় ১:১.৩৫। ২০২১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১ লাখ ১ হাজার ৬৯২। ওই বছর দেশটির গবেষকরা পেটেন্ট পান ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৯৫টি। অর্থাৎ দেশটির গবেষকদের গবেষণা প্রবন্ধের চেয়ে পেটেন্টের সংখ্যাই বেশি। পেটেন্ট পাবলিকেশন অনুপাত ছিল ১:০.৬৪। একই অবস্থা জাপানের ক্ষেত্রেও। দেশটির গবেষকদের প্রকাশনা ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৮টি ও পেটেন্ট ছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ১১৭টি। অর্থাৎ প্রকাশনার চেয়ে পেটেন্টর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। আর যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের ২০২১ সালে প্রকাশনা ছিল ৭ লাখ ২৬ হাজার ৫৫২টি ও পেটেন্ট ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৭৫টি। দেশটির পেটেন্ট ও পাবলিকেশনের অনুপাত দাঁড়ায় ১: ২.৪৩।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের গবেষকদের পেটেন্ট প্রাপ্তির হার খুবই কম। পেটেন্ট কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে পেটেন্ট না হওয়ার প্রধান কারণ হলো এর সংস্কৃতি গড়ে ওঠা। গবেষকদের মধ্যে পেটেন্ট-বিষয়ক সচেতনতা ও আগ্রহ অনেক কম। এজন্য গবেষণার বিষয় পরিকল্পনার সময়ই পেটেন্টের বিষয়টা সামনে আনা হয় না। আর যারা পেটেন্ট-কেন্দ্রিক কাজ করছেন তারাও পেটেন্ট অফিসের দীর্ঘসূত্রতার কারণে নানাভাবে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। আমি ২০১৮ সালে একটি পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছি, এখন পর্যন্ত সেটা উন্মুক্তই করা হয়নি। আবার একটা গবেষণাকে পেটেন্ট পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি কাঠামোর প্রয়োজন হয়। এ ধরনের সেবা দেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে বিশেষায়িত ফার্ম রয়েছে। যদিও আমাদের এখানে তা নেই। বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের একটি বড় খাত পেটেন্ট। অথচ আাামদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে বেশ নিষ্ক্রিয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞানের এ অধ্যাপক আরো বলেন, ‘এক দশক আগেও দেশের গবেষণা খাত বেশ অবহেলিত ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এক্ষেত্রে বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ হচ্ছে। সংখ্যাগত দিক থেকে হলেও এটা আরো সামনের দিকে নিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে ফোকাসড রিসার্চ তথা উচ্চতর গবেষণায় জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় এগোলে পেটেন্টের সংখ্যাও বাড়বে। এক্ষেত্রে নীতিগত জায়গায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। কেননা বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণ করলে বিদেশী অনেক পেটেন্ট বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবে না।’
জাতিসংঘের স্বত্ব সংরক্ষণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও)। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন নীতিমালা অনুসরণ করে পেটেন্ট দেয়। বাংলাদেশে এ বিষয়ে কাজ করে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, দেশে পেটেন্টের জন্য আবেদনের প্রবণতাও অনেক কম। আবার যে আবেদনগুলো পড়ছে তার বড় অংশই বিদেশী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের।
ডিপিডিটির তথ্যমতে, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে পেটেন্ট প্রাপ্তির আবেদন পড়ে ৪৪৭টি। এর মধ্যে ৩৭৮টি বিদেশী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের। আর ৬৯টি দেশের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের। ওই বছর ২৪০টি পেটেন্ট দেয়া হয়, যার মধ্যে ২১টিই বিদেশী। দেশীয় মাত্র ২৯টি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার (পেটেন্ট ও ডিজাইন) আলেয়া খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে পেটেন্টের জন্য যে আবেদনগুলো পড়ে এর বেশির ভাগই বিদেশী। দেশ থেকে আবেদন পড়ে খুবই কম। এজন্য পেটেন্ট প্রাপ্তির হারেও বিদেশী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে থাকে। বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের বাজারে পণ্য নিয়ে আসার জন্য পেটেন্টের আবেদন করে। আবেদন পাওয়ার পর আইন ও ডব্লিউআইপিওর বিভিন্ন নির্দেশনার আলোকে বিভিন্ন ধাপ সম্পন্ন করে পেটেন্ট দেয়া হয়।’