মরদেহ টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন প্রিয়া খান

‘‌আহত ও নিহত অবস্থায় যাদের আনা হয়েছে আমরা তাদের বহন করেছি। রক্তে ভিজে গেছে শরীর। যাদের ওষুধ দরকার ব্যবস্থা করেছি। অপারেশনের জন্য যেসব প্রসেস লাগে সবকিছুই করেছি। অনেককেই বলেছি ধরেন, আমাদের সহযোগিতা করেন। কেউ এগিয়ে আসেনি। এত দেহ টানতে টানতে ক্লান্ত হয়েছি, তবুও সরে যাইনি। কেউ কিন্তু এগুলো করতে বলেনি, মানুষের প্রতি মানুষের টান থেকে নিজেদের

‘‌আহত ও নিহত অবস্থায় যাদের আনা হয়েছে আমরা তাদের বহন করেছি। রক্তে ভিজে গেছে শরীর। যাদের ওষুধ দরকার ব্যবস্থা করেছি। অপারেশনের জন্য যেসব প্রসেস লাগে সবকিছুই করেছি। অনেককেই বলেছি ধরেন, আমাদের সহযোগিতা করেন। কেউ এগিয়ে আসেনি। এত দেহ টানতে টানতে ক্লান্ত হয়েছি, তবুও সরে যাইনি। কেউ কিন্তু এগুলো করতে বলেনি, মানুষের প্রতি মানুষের টান থেকে নিজেদের উদ্যোগেই করেছি।’ 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) জরুরি বিভাগে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা প্রিয়া খান তার অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বণিক বার্তার কাছে তুলে ধরেন। শাহবাগ থানার হিজড়া কমিউনিটির এ সদস্যের সঙ্গে আরো ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের মুক্তা, নদী, বৈশাখী, মুগ্ধ ও হাবিবা। গত ১৬ জুলাই রাত থেকে ৬ আগস্ট ভোর ৪টা পর্যন্ত তারা জরুরি বিভাগের সামনে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ছিল তাদের এ কার্যক্রম।

ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সচরাচর যে চিত্র দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিনগুলোয় ছিল তা একেবারেই ভিন্ন। কিছুক্ষণ পরপরই রিকশা-ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, মিনি ট্রাকে করে নিয়ে আসা হচ্ছিল হতাহতদের। তারা বেশির ভাগই ছিল গুলিবিদ্ধ; কারো হাত, কারো পা, বুক, গলা কিংবা মাথায় গুলি। মরদেহগুলোর অধিকাংশেরই গুলিতে বুক-মাথা ঝাঁজরা ছিল; পুরো দেহ ছিল রক্তাক্ত। কখনো কখনো এসেছে গাড়িভর্তি লাশের স্তূপও। তবে গাড়ি থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাওয়া, ভর্তি করা, ওষুধ ও রক্তের ব্যবস্থা করা, মরদেহগুলো নির্দিষ্ট স্থানে রাখা—এমন সব কাজের জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত লোকবল ছিল না। আবার যারা ছিলেন তাদের ভূমিকাও ছিল অনেকটা গা-ছাড়া। এসব কাজ করতে করতে স্বেচ্ছাসেবীরা হাঁপিয়ে উঠছিলেন। 

ঢামেক জরুরি বিভাগের সামনেই গত বুধবার কথা হয় মানবিক এ কাজের মূল উদ্যোক্তা প্রিয়া খানের সঙ্গে। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘‌১৭ জুলাই থেকে শুরু হয় বিভীষিকাময় অবস্থা। গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকেই আসেন, মরদেহ আসছে। শুধু যে ছেলে তা নয়, নারী ও শিশুরাও ছিল। গুরু মাকে বললাম আমরা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের থেকে টাকা নিয়াই খাই। তারা বিপদে আছে মানে আমাদেরও বিপদ। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। তখন গুরু মা বললেন কী করতে চাও? আমি বললাম, আমরা যে ক’জন পারি ঢামেকে স্বেচ্ছাশ্রম দেব। তারপর জরুরি বিভাগে কাজ শুরু করলে কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করে, কার অনুমতি নিয়ে আমরা এখানে কাজ করছি। আমাদের সঙ্গে অনেক বাক্‌বিতণ্ডাও হয়। বলেছি, আমরা ঢাবিতে কালেকশন করে খাই, তাই নিজ উদ্যোগে এখানে এসেছি। প্রথমে স্ট্রেচার ধরা শুরু করি। আহত ও মৃত অনেক মানুষ এসেছে তাদের বহন করেছি।’ 

প্রিয়া খান জানান, হাসপাতালে ১৮ জুলাই থেকে বাড়তে থাকে ভয়াবহতা। প্রয়োজন পড়ে অনেক রক্তের। কয়েকজনের সহায়তায় ঢামেকের জরুরি বিভাগের সামনে বসানো হয় রক্ত সংগ্রহের বুথ। তবে রক্ত সংগ্রহের জন্য ব্যাগ চাইলে সেটাও ঢামেক থেকে দেয়া হয়নি। বলা হয়, ‘‌যেহেতু আপনারা সংগ্রহ করছেন ব্যাগের ব্যবস্থাও আপনারা করেন।’ পরে বাইরে থেকেই ব্যাগ সংগ্রহ করা হয়। ওই বুথের মাধ্যমে ৭৩০ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে তৃতীয় লিঙ্গের ৩৬ সদস্যও রক্ত দেন। আহতদের জন্য জরুরি ওষুধের ব্যবস্থা করতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা অনুদান সংগ্রহ করেন প্রিয়ারা। ঢামেকে ভর্তি রোগীরাও অর্থ সহায়তা করেছেন। 

দেশটা ছিল মগের মুল্লুক উল্লেখ করে প্রিয়া খান বলেন, ‘‌হাসপাতালের সবাই জানে, এখানে জরুরি বিভাগের সামনে গাড়িতে রোগী পড়ে থাকে কিন্তু কোনো স্টাফ তাদের ধরে না। আমরা সেটা করতে দিইনি। নিজেরাই তুলে নিয়েছি। যাকে স্ট্রেচারে নেয়া সম্ভব না তাকে কোলে তুলে নিয়েছি। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো এক লোক সিএনজি অটোরিকশায় করে যাত্রাবাড়ী থেকে তিনটা মরদেহ নিয়ে আসেন। প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে জরুরি বিভাগের সামনে গাড়ির ভেতরে সেগুলো পড়ে ছিল। কেউ বের করে ভেতরে নেয়নি। সিএনজি অটোরিকশাচালক বললেন, আমাকে লাশগুলো দিয়ে পাঠিয়েছে, আমি এত রাতে এগুলো নিয়ে কোথায় যাব?’

অনেকেই দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছেন জানিয়ে এ স্বেচ্ছাসেবী বলেন, ‘একটা গাড়িতে ছয়টা রোগীও আসছে। তিনজনই মারা গেছে, তার পাশে আহত পড়ে আছে অন্যরা। এত গাড়ি এসেছিল যে একটা অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে ১০টা অ্যাম্বুলেন্সের লাইন লেগে গিয়েছিল। এত গাড়ি থেকে এখানে কতক্ষণ পরপর লোক নামাতে হতো। যারা এখানে আসছে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে, কেউ একটা লাশ ধরেনি। আমার গুরু মার বয়স ৭০ বছর, তিনি যদি একজন আহতকে ধরে নিয়ে যেতে পারেন, একটা লাশ বহন করতে পারেন অন্যরা কেন পারবে না। কিন্তু তারা কেউ করেনি।’ 

১৯ ও ২০ জুলাই বেশি মরদেহ এসেছে বলে জানান প্রিয়া খান। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিন যেসব লাশ এসেছে তাদের পায়ে-হাতে গুলি ছিল। কিন্তু এরপর যা আসছে তাদের কোমর থেকে বুক, মাথার ওপরের অংশ গুলিবিদ্ধ ছিল সবার। কত লোক মারা গেছে সঠিক তথ্য কেউ দেবে না। মেডিকেল থেকেও দেবে না। অনেকেই জানত না আমরা স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছি। কারফিউ জারির পরও আমরা সিদ্ধান্ত নেই মরলে এখানেই মরব, বাসায় যাব না। তখন ওপরে হেলিকপ্টার টহল চলছিল। এ দুঃসময় চোখের পানি ধরে রাখার মতো অবস্থা ছিল না। পুরো শরীর রক্তে ভেজা। এমনো দিন গেছে রক্তের গন্ধে খেতে পারিনি। ২৩ জুলাই দুপুর বেলা এসে দেখি ফ্লোর ভরা লাশ পড়ে আছে।’ 

২৫ জুলাই ঘটে সবচেয়ে নজিরবিহীন ঘটনা, যা হয়তো সারা বিশ্বে কোথাও হয়নি। গুলিবিদ্ধ যেসব লোক ঢামেকে এসেছিলেন তাদেরকে ধরে ধরে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া হয়েছে। অথচ ফিঙ্গার নেয়ার মতো শারীরিক অবস্থা তাদের ছিল না। প্রতিটি রুম বন্ধ করে ফিঙ্গার নেয়া হয়েছে, যাতে কেউ বের হয়ে চলে যেতে না পারে। এ ঘটনার পরই আন্দোলনে আহত অনেক মানুষই হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেককে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

এ ঘটনার বর্ণনায় প্রিয়া খান বলেন, ‘‌আমি ঢামেক কর্তৃপক্ষকে বললাম আহতরা আগে বাঁচুক। সবার ফোন নম্বর দেয়া আছে। তাদের পরে খুঁজে বের করেন। সবাই বিপদগ্রস্ত তাদের তো এখন ফিঙ্গার নেয়ার প্রয়োজন নেই। তখন কর্তৃপক্ষ আমাদের বলল এখানে আসার অনুমতি দিয়েছে কে? আপনাদের নামে মামলা দেব। কর্তৃপক্ষ কতজনকে লাশ দিয়েছে তার কোনো প্রমাণ রাখেনি। অনেকের লাশ তিনদিন ধরে পড়ে ছিল, তবুও স্বজনদের দেয়নি। পচে গন্ধ বের হয়েছে। রক্তের গন্ধে দাঁড়ানো যেত না। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জোর করে অনেক স্বজনের কাছে আমি লাশ হস্তান্তর করে দিয়েছি।’

আরও