শাহপরী

দ্বীপ ছোট উদ্বেগ বড়

প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে আলাদা করেছে নাফ নদী। এ নদীর মোহনায় অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপ। ১৯৯২ সালে যখন দেশে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল টেকনাফের এ দ্বীপকে। সবশেষ ২০১৭ সালেও এটি হয়ে ওঠে রোহিঙ্গা প্রবেশের অন্যতম পথ। কেবল রোহিঙ্গাদের জন্যই নয়, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ডে অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরও পছন্দের

প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে আলাদা করেছে নাফ নদী। নদীর মোহনায় অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপ। ১৯৯২ সালে যখন দেশে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল টেকনাফের দ্বীপকে। সবশেষ ২০১৭ সালেও এটি হয়ে ওঠে রোহিঙ্গা প্রবেশের অন্যতম পথ। কেবল রোহিঙ্গাদের জন্যই নয়, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ডে অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরও পছন্দের রুট এটি। পথ ব্যবহার করেই নিয়মিত মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। শুধু তা- নয়, ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ বা আইসসহ বিদেশী বিভিন্ন ধরনের মাদক পথ দিয়েই প্রবেশ করে বাংলাদেশে। ফলে বঙ্গোপসাগরের উন্মুক্ত জলরাশির সীমানায় অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপটি ক্রমেই দেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ, উখিয়া নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পার হয়ে অস্ত্র মাদক ঢুকছে সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ করিডরে। পরবর্তী সময়ে এসব মাদক অস্ত্রের চালান চলে যাচ্ছে টেকনাফের জালিয়াপাড়া, হোয়াক্ষ্যংয়ের জিমনখালী, নয়াপাড়া, আমতলী এলাকায়। সেখানে কয়েক হাত ঘুরে মাদক অস্ত্রের চালান ছড়িয়ে দেয়া হয় পুরো দেশে। গত চার বছরে শুধু কোস্টগার্ডের অভিযানেই কক্সবাজারের সমুদ্র এলাকা থেকে কোটি ৭২ লাখ হাজার ৪৮১ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার পাশাপাশি এখন ভয়ংকর মাদক আইসের চালান দেশে ঢুকছে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে। গত বছর সেখান থেকে এক কেজি আইস উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।


গুরুত্বপূর্ণ একটি সীমানা পয়েন্ট এভাবে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কাজে ব্যবহার হওয়াকে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। শাহপরীর দ্বীপে কঠোর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি মাদক বা অস্ত্র চোরাচালান রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ২৭ এপ্রিল ভোররাতে শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণপাড়ায় অভিযান চালিয়ে এক লাখ ইয়াবা পাঁচ কেজি গাঁজা আটক করে পুলিশ। শাহপরীর দ্বীপের পাশাপাশি লম্বাবিল, কানজরপাড়া, মিনাবাজার, হূীলা লেদা, জাদিমুড়া, মমিয়া, টেকনাফ সদর, সাবরাং সাগর পথ দিয়েও নিয়মিত ঢুকছে মাদক। ঈদকে কেন্দ্র করে গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেই প্রায় তিন লাখ ইয়াবা, আড়াই কেজির বেশি ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, বিদেশী মদ বিয়ার জব্দ করার পাশাপাশি রোহিঙ্গাসহ ১৬ জনকে আটক করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদকের পাশাপাশি দেশে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশেরও অন্যতম নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে শাহপরীর দ্বীপের করিডর।

তবে শাহপরীর দ্বীপ এর আশপাশের সমুদ্র এলাকায় মাদক, অস্ত্র মানব পাচারকারীদের তত্পরতা ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন কোস্টগার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লাবিব উসামা আহমাদুল্লাহ্। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ধরনের অপরাধের বিষয়ে আগাম তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রমও পরিচালনা করা হয়। এরপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফলে এলাকার অপরাধপ্রবণতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে।

গত ছয় মাসে শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে আড়াই লাখ পিস ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টেকনাফ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বণিক বার্তাকে বলেন, মাদক মানব পাচার রোধে শাহপরীর দ্বীপে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া ঘোলারপাড়া নামে দুটি চোরাই পয়েন্ট রয়েছে। এগুলো বহুল আলোচিত হলেও এখনো এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দুটি পয়েন্ট দিয়েই হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

দেশে প্রবেশের রুট ইয়াবা, মানব পাচারের ট্রানজিট রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের মূল পয়েন্ট হয়ে ওঠার পরিপ্র্রেক্ষিতে গত বছর সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিরোধে কার্যক্রম বাড়ানো হয়। দেখা যায়, অভিযানের কিছুদিন মাদক চোরাচালান মানব পাচার কমে আসে। নজরদারি কমে গেলে তা আবার বেড়ে যায়। বিশেষ করে শীতে সমুদ্র শান্ত হলে মানব পাচারের সংঘবদ্ধ চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবিরভিত্তিক বেশকিছু ইয়াবা সিন্ডিকেটের খোঁজ পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন সংস্থার গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প এলাকায় ইয়াবা আটকের পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়ে গেছে মাদক মামলা আসামির সংখ্যাও। সম্প্রতি মালয়েশিয়া পাচারকালে কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া শহরের নুনিয়াছড়া এলাকা থেকে দুটি চালান আটক করে র্যাব পুলিশ।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, নাফ নদী পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে দেশে প্রবেশের পর অবৈধ অস্ত্র, ইয়াবা অন্যান্য মাদক মজুদের জন্য ব্যবহূত হচ্ছে উখিয়া টেকনাফে অবস্থিত ৩৪ রোহিঙ্গা শিবির। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তালিকায়ও রয়েছে ১৩ জন রোহিঙ্গা নেতার নাম। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এসব শিবিরের নারী, বিশেষ করে যাদের স্বামী বেঁচে নেই তারা বেশি জড়াচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়।

তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান জানিয়েছেন, পুলিশ অন্যান্য বাহিনীর তত্পরতায় স্থানীয় লোকজন এখন ইয়াবা কারবারে খুব একটা জড়াতে চায় না। সীমান্ত রোহিঙ্গা শিবিরে ইয়াবা সিন্ডিকেট কারবারিদের পুলিশ নিয়মিত আটক করছে এবং তাদের মাঝে মাদকবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, শাহপরীর দ্বীপে আমাদের একটি পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে, সেখানে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বক্তব্য দিলেও স্থানীয়রা বলছেন, শীত মৌসুমকে সামনে রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক মানব পাচার চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব চক্র সাগরপথে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রোহিঙ্গাদের প্রলুব্ধ করে। এরপর সাগরে জঙ্গলে নির্মম নির্যাতন করে মোটা অংকের টাকা আদায় করে। শাহপরীর দ্বীপ ব্যবহার করে ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য জানান, পাচারের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে রোহিঙ্গাদের দ্বীপেই নিয়ে আসে মানব পাচারকারীরা। তারপর ছোট ছোট নৌকার মাধ্যমে তাদের বঙ্গোপসাগরের গভীরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের সমুদ্রের গভীরে নিয়ে বড় নৌকায় তুলে দেয়া হয় মালয়েশিয়ায় পাচারের জন্য।

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের দিকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড মালয়েশিয়ায় পৌঁছার চেষ্টা করে। এরপর উন্নত জীবনের সন্ধানে বাংলাদেশীরাও বিপত্সংকুল পথে যাত্রা করতে থাকে। ২০১২ সালে প্রথম মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর চেষ্টার অভিযোগে বঙ্গোপসাগরে ১৩২ জনকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ২০১৪ সালে সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৫০।

আরও