রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে সরবরাহ নেই মোটা চালের। ব্যবসায়ী ও মোকাম মালিকরা জানিয়েছেন, বাজারে প্রচলিত মোটা চালগুলো মূলত আমন মৌসুমের হাইব্রিড, গুটি স্বর্ণা এবং সুমন স্বর্ণা জাতের ধান থেকে উৎপাদিত। গত বছরের আমন মৌসুমের ধান মজুদ শেষ হয়ে আসার পাশাপাশি আমদানি বন্ধ থাকায় মোটা চালের সরবরাহ এখন এক প্রকার বন্ধ। তবে এ পরিস্থিতি সাময়িক দাবি করে চালকল মালিকরা বলছেন, নভেম্বরের শেষ দিকে বাজারে চলতি আমন মৌসুমের ধান সরবরাহ শুরু হবে। একই সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে আসবে মোটা চালের সরবরাহও।
মোটা, মাঝারি ও সরু—বাজারে মূলত এ তিন ক্যাটাগরির চাল পাওয়া যায়। মোটা চালের মধ্যে রয়েছে স্বর্ণা, চায়না ইরি, হাইব্রিড ও আমদানীকৃত মোটা চাল। মাঝারি চালের জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে পাইজাম, লতা, ব্রি-২৮ ও পারিজা। সরু চালের মধ্যে রয়েছে নাজির, কাটারিভোগ, জিরাশাইল ও মিনিকেট। মিল মালিকরা জানিয়েছেন, বাজারে এখন মোটা চাল হিসেবে যেটি বিক্রি হচ্ছে সেটি আসলে ব্রি-২৮ জাতের, যা মূলত মাঝারি ক্যাটাগরির।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে মোটা চাল তেমন একটা দেখা যায়নি। হাতেগোনা অল্প কিছু দোকানে স্বর্ণা পাওয়া গেলেও সেগুলো মূলত আগের কিনে রাখা। সরজমিনে ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে খুচরা বাজারে সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে ব্রি-২৮ ও পাইজাম জাতের চাল। এর মধ্যে পাইজাম চাল প্রতি কেজি ৫৫-৫৬ টাকা এবং ব্রি-২৮ জাতের চাল প্রতি কেজি ৫৮-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সরু চালের মধ্যে রয়েছে মিনিকেট ও নাজির। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট মানভেদে ৭০-৭৫ টাকা এবং নাজির বা কাটারি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা করে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা মূলত আমন মৌসুমের জাত। এ চাল বাজারে আসতে শুরু করবে নভেম্বরের শেষে। এছাড়া আমন ও বোরো মৌসুমে হাইব্রিড জাতের কিছু মোটা ধান থাকলেও সেগুলো কৃষক ও মিল মালিকরা সাধারণত সরকারের কাছে বিক্রি করে দেন। আর কিছু মোটা চাল সাধারণত সরকারিভাবে আমদানি করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিতরণের জন্য। তবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি। সরকারিভাবে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত আমদানির পরিকল্পনাও নেই।
চালকল, মোকাম ও পাইকারি পর্যায়েও এখন মোটা চালের সরবরাহ নেই। কারওয়ান বাজারে চালের পাইকারি আড়তে এখন প্রতি কেজি ব্রি-২৮ চাল কেজিপ্রতি ৫৫-৫৬ টাকা ও পাইজাম ৫৪-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর সরু চালের মধ্যে নাজির বা কাটারি কেজিপ্রতি ৬৪-৭৮ টাকা, মিনিকেট ৬৬-৬৮ ও বাসমতী ৮০-৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও ব্রি-২৮ জাতের চাল প্রতি কেজি ৪৯-৫০ টাকা এবং মিনিকেট ৬২-৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা জানান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সূচক তৈরির ক্ষেত্রে সাধারণত মোটা চালের বাজারদরকে বিবেচনায় নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান থেকে সর্বশেষ দরের তথ্য নেয়া হয়। কিন্তু বাজারে মোটা চালের অনুপস্থিতিতে শুধু এর সর্বশেষ মূল্য নিলে তথ্যগত বিভ্রান্তির আশঙ্কা থেকে যায়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মোটা চালের দাম বিবেচনায় নিয়েই বেশির ভাগ সূচক তৈরি হয়। বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও ব্যবহার করা হয়। এখন দিন দিন মোটা চালের উৎপাদন কমে আসছে। রাজধানীর বাজারে এখন কম দামি চাল বলতে আছে ব্রি-২৮। তাও প্রতি কেজি ৫৮-৬০ টাকা। তাহলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজারে যে চাল থাকে সে দামকেই সর্বনিম্ন মূল্য হিসেবে বিবেচনায় নেয়া উচিত। তাহলে সঠিক তথ্য সরবরাহ হবে।’
দেশের বৃহত্তম চাল সরবরাহকারী জেলা নওগাঁর মোকামগুলোয়ও এখন মোটা চালের সরবরাহ নেই। এখানে এখন সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে পারিজা, সুভলতা ও ব্রি-২৮ জাতের চাল। এর মধ্যে পারিজা কেজিপ্রতি ৪৫-৪৯ টাকা, ব্রি-২৮ চাল ৫১-৫৪, সুভলতা ৫২-৫৫, জিরাশাইল ৫৮-৬২ ও কাটারিভোগ ৬০-৬৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটা চালের মধ্যে হাইব্রিড, গুটি স্বর্ণা ও সুমন স্বর্ণা উৎপাদন হয় আমন মৌসুমের ধান থেকে। মাঝারি ক্যাটাগরির ব্রি-২৮, সুভলতা ও পারিজা আসে বোরো মৌসুমের ধান থেকে। স্বর্ণা-৫ জাতের চাল উৎপাদন হয় আমন মৌসুমের ধান থেকে। এছাড়া সরু চালের মধ্যে জিরাশাইল ও কাটারিভোগ—এ দুই জাতই বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকে পাওয়া যায়।
নওগাঁ শহরের মশরপুর বাইপাস এলাকার আল রাজী চালকলের স্বত্বাধিকারী সুমন কবিরাজ বলেন, ‘আমনে উৎপাদিত মোটা চালের সরবরাহ প্রতি বছরই মৌসুমের শেষ মুহূর্তে এসে ফুরিয়ে যায়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। মোটা চাল এখন কোনো মোকামেই নেই। ১৫ নভেম্বরের পর থেকে জেলায় পুরোদমে আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হবে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসব ধান বাজারে আসবে। তখন বাজারে মাঝারি ও মোটা চালের ভোক্তা পর্যায়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে। তবে চিকন চালের দাম আগামী বছর বোরো মৌসুমের আগে আর কমবে না।’
রাজধানীর খুচরা ও পাইকারিতে গত এক মাসে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে মানভেদে ২-৫ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে ব্রি-২৮ চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৬ টাকা। নওগাঁর মোকামগুলোয়ও পাইকারি পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম প্রতি কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছে। ধানের সরবরাহ সংকটের কারণে চালের দামে আকস্মিক এ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন চালকল মালিক ও আড়তদাররা। যদিও খুচরা ব্যবসায়ীরা এজন্য দায়ী করছেন সিন্ডিকেটের কারসাজিকে। কারওয়ান বাজারের জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. লোকমান হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মোটা চাল বাজারে নেই। মাঝারির মধ্যে এখন ব্রি-২৮ জাতের চাল রয়েছে। গত কিছুদিনে এ জাতের চালের দাম মিল পর্যায়ে বেড়েছে। এ কারণে আমরাও বেশি দামে বিক্রি করছি।’
তবে বাজারে ধানের সরবরাহ কম জানিয়ে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মৌসুমের শেষ পর্যায়ে প্রতি বছরই বাজারে স্বাভাবিকভাবেই পুরনো ধানের সংকট দেখা দেয়। সে সংকটের কারণেই চালের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। জেলায় এরই মধ্যে পুরোদমে আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। আশা করছি নতুন আমন ধান বাজারে এলে চালের দাম আবারো কিছুটা কমবে।’
প্রায় প্রতি বছরই চাল আমদানি করে সরকার। গত অর্থবছরেও প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়। তবে এ বছর চাল আমদানি না করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিগত মৌসুমগুলোয় উৎপাদন ভালো হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে সরবরাহ সংকট ও সিন্ডিকেশনের কারণে চালের দাম বাড়ছে। সরবরাহে সংকট দেখা দিলে তখন সিন্ডিকেশনও কাজ করে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একদম মোটা চালের উৎপাদন সীমিত। উৎপাদনের পর এগুলো শুরুতে সরকারি পর্যায়ে আসে এবং কিছুদিন পর বাজারে পাওয়া যায়। আমদানির কিছু চাল মোটা হয়। সরকারিভাবে বিতরণের জন্য সরু চালও কেনা হয়। আমদানি বন্ধ থাকায় মোটা চাল বাজারে এখন কম। আমনে মোটা চাল উৎপাদন হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমনের ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগামী সপ্তাহে বাজারে মোটা চাল চলে আসবে। আমাদের সরকারি বিতরণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। মৌসুমের শেষ সময় হওয়ায় অনেকে সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে আমন মৌসুমের চাল বাজারে চলে এলে দাম কমে যাবে। এর পাশাপাশি বাজারে আমরা তদারকিও করছি।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার নওগাঁ প্রতিনিধি আরমান হোসেন রুমন)