নড়াইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবাধে চলছে অর্ধশতাধিক ইটভাটা। ফসলি জমি দখল করে গড়ে তোলা এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে আশপাশের কৃষিজমির ফসল। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। দু-একটি অভিযান ছাড়া এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
এদিকে ভাটা এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। দ্রুত অনুমোদনহীন এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ৬৮টি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র ১৫টির। বাকি ৫৩টি ভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। সেই হিসাবে জেলায় ৭৭ শতাংশ ইটভাটাই অনুমোদনহীন। স্থানীয়রা জানান, অনুমোদনের তোয়াক্কাই করেন না অধিকাংশ ইটভাটামালিক। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ভাটায় ইট পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ইটের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহার হচ্ছে। ফলে একদিকে নির্বিচারে নিধন হচ্ছে গাছপালা, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে কৃষিজমি। এতে কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
ভাটা সূত্রে জানা গেছে, আকারভেদে একটি ইটভাটা গড়ে তুলতে কমপক্ষে পাঁচ একর (৫০০ শতক) জমির প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো ইটভাটা তৈরি করতে ২০-২৫ একর জমি প্রয়োজন হয়। এক যুগ আগে জেলায় ২০-২৫টি ভাটা ছিল, কিন্তু এখন তা বেড়ে প্রায় তিন গুণে পৌঁছেছে। আর এসব ইটভাটা তৈরি করতে অন্তত ৪০০ একর ফসলি জমি ব্যবহূত হয়েছে বলে কৃষকের দাবি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভাটামালিক জানান, মধ্যম সারির একটি ভাটায় মৌসুমে ৪০-৫০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। প্রতি আট হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। কৃষিজমি থেকে এ মাটির জোগান দেয়া হয়। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে সাত-আট একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহূত হয়। সে হিসেবে ৬৮টি ভাটায় প্রতি বছর অন্তত ৩৫০ একর জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহূত হয়।
প্রতিদিন ইট পোড়ানোর জন্য গড়ে প্রতিটি ভাটায় ৪০০-৫০০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। তাহলে জেলার কেবল অনুমোদনহীন ৫৩টি ইটভাটায় প্রতিদিন অন্তত ২১ হাজার ২০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়।
লোহাগড়া উপজেলার আড়িয়ালা এলাকার কৃষক মো. আলিম জানান, তার ফসলি জমির পাশে অনুমোদনহীন ভাটা রয়েছে। ভাটার মালিক এলাকার প্রভাবশালী। ভাটার আশপাশে শত শত কৃষকের ফসলের ক্ষতি হলেও ভয়ে কোনো কৃষক কথা বলেন না। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
লোহাগড়া উপজেলার শামুকখোলা গ্রামের বাসিন্দা আজমল মোল্লা জানান, ভাটায় যে মাটি যাচ্ছে তার বেশির ভাগই ফসলি জমির উপরিভাগের।
নড়াইল সদর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মশিউর রহমান জানান, তাদের এলাকায় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। অনর্গল কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে ভাটার চিমনি দিয়ে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীসহ আশপাশের মানুষ। এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তিনি।
নড়াইল সদরের আউড়িয়া এলাকার আতিকুল ইসলাম জানান, ভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এদিকে নজর দেয়ার কেউ নেই।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্থানীয় এনজিও ‘সাবলম্বী’র নির্বাহী পরিচালক কাজী হাফিজুর রহমান জানান, বেশির ভাগ ভাটায় কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। চোখের সামনে দিয়েই অনবরত কাঠবোঝাই যানবাহন প্রবেশ করে ভাটায়। ভাটাগুলোয় মজুদ রয়েছে হাজার হাজার মণ কাঠ। কৃষিজমি এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ভাটায় কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে অনবরত। এতে ফসলসহ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ইটভাটার যেসব আইন রয়েছে সে আইন যথাযথ প্রয়োগ করে পরিবেশঘাতি কর্মকাণ্ড অচিরেই বন্ধ করা উচিত।
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ইটভাটা পরিচালনার ক্ষেত্রে কয়লা না পুড়িয়ে কেন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশ ভাটার মালিকের কাছ হতে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন ভাটামালিক জানান, কয়লার দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক। কয়লা দিয়ে কাঠ পোড়ালে যে খরচ হয় তাতে ইটের দাম বেড়ে যাবে দ্বিগুণ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গোপনে মোটা অংকের টাকা দিয়ে কাঠ পোড়াচ্ছেন বলে জানান ভাটা মালিকরা।
লোহাগড়া উপজেলার পদ্মবিলা এলাকার ‘শেখ ব্রিকস’-এর স্বত্বাধিকারী হুমায়ুন কবির জানান, তার ভাটায় প্রতিদিন প্রায় ২০০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। কয়লার পরিবর্তে কেন কাঠ পোড়াচ্ছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জেলার সব ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে, তাই আমিও পোড়াচ্ছি।’
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দীপক কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে সে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী কয়েক বছর ফসল উৎপাদন অনেক কমে যায়। ফসলি জমির আশপাশে ইটভাটা থাকলে উৎপাদন অনেক কমে যায়। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাব যে সকল ইটভাটার মালিকেরা ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।’
নড়াইল পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শেখ কামাল মেহেদী বলেন, মোট ১৫টি ভাটার অনুমোদন (ছাড়পত্র) দেয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে নড়াইলের অবৈধ ভাটাগুলোয় অভিযান চালিয়ে পাঁচটি ভাটার ইট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে মূলত সেখানে অভিযান চালানো হচ্ছে। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নড়াইল সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (সংযুক্ত) মুন্সি আসাদুজ্জামান দিপু বলেন, ভাটার কালো ধোঁয়া মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ কালো ধোঁয়ার ফলে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা থাকে বেশি ঝুঁকিতে।
জেলা প্রশাসক মোহম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, শুনেছি কিছু ইটভাটামালিক কয়লা ব্যবহার না করে কাঠ দিয়ে ইট পোড়াচ্ছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব ভাটায় অভিযান পরিচালনা করছি। আইন অমান্যকারী সব ইটভাটা মালিককে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। প্রয়োজনে ইটভাটা বন্ধ করে দেয়া হবে।’