দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। পানিতে ডুবে যাওয়া স্থানগুলোয় ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সারফেস পেভমেন্ট (ওপরের পিচ) উঠে গিয়ে তৈরি হয় ছোট-বড় গর্ত। বিভিন্ন স্থানে সড়ক বিভাজক, সড়ক বাঁধ ও কালভার্টের নিচ থেকেও মাটি সরে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে কোনো রকম মেরামত করে মহাসড়কটিকে যান চলাচলের উপযোগী রাখা হয়েছে।
ভারি বৃষ্টি ও উজানের পানিতে আগস্টে প্লাবিত হয় ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৭৭টি সড়ক, যার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৯৬৯ দশমিক ৫২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে ১১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার। একইভাবে ২০৩ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ৬৫০ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার জেলা মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেট জোনের ১৪টি সড়ক বিভাগে সড়ক, সেতু ও কালভার্টের ক্ষতি হয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য নিয়ে করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ অধিদপ্তরটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টের বন্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও ফেনীর লালপোল এলাকায়। এ দুই এলাকায় বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২০ কিলোমিটার সড়ক পানির নিচে ডুবে ছিল। পানি সরে যাওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় বড় বড় গর্ত। কোথাও কোথাও ডেবে যায়। ব্যাহত হয় যান চলাচলের স্বাভাবিক গতি, সৃষ্টি হয় যানজট। পরে জরুরি ভিত্তিতে মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ কোনো রকমে মেরামত করা হয়। তবে মহাসড়কটিতে ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সংস্কার করতে কত টাকা লাগতে পারে—এসব বিষয় পর্যালোচনা করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত কর্মসূচি গ্রহণের কথা জানিয়েছেন সওজের প্রকৌশলীরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সরজমিন পরিদর্শন করে বণিক বার্তার কুমিল্লা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বন্যায় মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। সে সময় মহাসড়ক কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর সমান পানির নিচে ডুবে ছিল। টানা কয়েক দিন পানি মহাসড়কে থাকার কারণে বিভিন্ন স্থানে পিচ ঢালাই উঠে গিয়ে অসংখ্য ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে একটু বৃষ্টি হলেই গর্তগুলো পানিতে ভরে যাচ্ছে। এতে ব্যস্ততম মহাসড়কটিতে যানবাহন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বন্যায় পানিতে ডুবে যাওয়া মহাসড়কের ওপর অসংখ্য যানবাহন আটকে পড়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সওজের ফেনী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বিনয় কুমার পাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বন্যার সময় অনেক যানবাহন মহাসড়কের ওপর আটকে পড়েছিল। এর মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহনও ছিল। পানিতে তলিয়ে থাকা সড়কের ওপর দীর্ঘ সময় আটকে থাকার কারণে এসব যানবাহন সড়কের ক্ষতি করেছে বেশি। আবার পানিতে ডুবে থাকা সড়কের ওপর দিয়েও যানবাহন চলাচল করেছে। এটাও সড়কের ক্ষতি বাড়িয়েছে। অনেক জায়গায় সড়ক বিভাজকের মাঝখানে মাটি ধুয়ে গেছে। কিছু জায়গায় কালভার্টের নিচেও মাটি সরে গেছে। পেভমেন্টের কিছু সারফেসিং ক্ষতি হয়েছে। সড়ক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
সওজের সড়ক নেটওয়ার্কে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কিত প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জরুরি ভিত্তিতে মেরামতকাজ করায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী বিনয় কুমার পাল বলেন, ‘আমরা গর্তগুলো মেরামত করেছি। ভেঙে যাওয়া সড়ক বাঁধ জরুরি ভিত্তিতে মেরামত হয়েছে। কিছু জায়গায় ডাম্পিং করা হয়েছে, ফেলা হয়েছে বালির বস্তা। তবে এখনো কাজ চলমান। বন্যার পর রাস্তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক মেরামত করতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে এবং কবে নাগাদ এ কার্যক্রম শুরু হবে, জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কের পাশাপাশি বিভিন্ন সেতুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তথ্যাদি এখনো চূড়ান্তভাবে পর্যালোচনা করা হয়নি। পর্যালোচনার পর বোঝা যাবে, কখন কী করতে হবে। যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা সবার আগে আমরা করব।’
সওজের প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বন্যার কারণে এখনো দেশের তিনটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সোনাগাজী-ওলামাবাজার-চরদরবেশপুর-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের ষষ্ঠ কিলোমিটারে অবস্থিত ছোট ফেনী সেতুর সংযোগ ভেঙে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ আছে। এরই মধ্যে অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা ক্ষতিগ্রস্ত সেতুটি পরিদর্শন করেছেন। বর্তমানে জরুরি মেরামতকাজ চলছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় দেশের বিভিন্ন সড়ক আংশিকভাবে ‘ওয়াশ আউট’ হয়েছে। ধসে পড়েছে সড়ক বাঁধ। বিভিন্ন অংশে ‘সারফেস পেভমেন্ট’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অসংখ্য গর্ত তৈরি হয়েছে।
বন্যায় দেশের প্রধান সড়কগুলোর সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিভিন্ন সড়ক বিভাগ থেকে আমরা ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসাব পেয়েছি। এগুলো যৌথভাবে মূল্যায়ন করা হবে। মূল্যায়ন শেষে মেরামত কর্মসূচি অনুমোদন করা হবে। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো মেরামতের জন্য আমরা দরপত্র আহ্বান করব। তবে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সড়কগুলো যান চলাচল উপযোগী রেখেছি। বহু জায়গায় মেরামতের কাজ চলছে।’