খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বারবারই আমদানির দিকে ঝুঁকতে হয় বাংলাদেশকে। আর কৃষিপণ্যের উল্লেখযোগ্যই আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। কখনো কম আবার কখনো বেশি হলেও বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা এখন অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণেই এ নির্ভরশীলতা বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। আবার পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় ভারতের কৃষিজপণ্য এদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গেও মিল রয়েছে। এসব কারণেই বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভারতীয় কৃষিপণ্যের শীর্ষ গন্তব্য।
ভারতের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এপিইডিএ) তথ্যও বলছে, তাদের কৃষিপণ্য রফতানির শীর্ষ গন্তব্য বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটির মোট কৃষিপণ্য রফতানির ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশই বাংলাদেশে এসেছিল, যার অর্থমূল্য ছিল ২৮৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশের পর ভারতের কৃষিপণ্যের বৃহৎ আমদানিকারক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, সৌদি আরব, নেপাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো বেশকিছু দেশ।
কাঁচামরিচের সরবরাহ কম থাকায় সম্প্রতি নিত্যপণ্যটির দাম কেজিপ্রতি হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। একপর্যায়ে যশোরের বেনাপোল, সাতক্ষীরার ভোমরা ও দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে মরিচ আমদানি শুরু হয়। পরের দিনই দাম কমতে থাকে। কাঁচামরিচের মতো একই ঘটনা ঘটে পেঁয়াজ নিয়েও। বছরখানেক আগে চিনির ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
ভারতের বাণিজ্য বিভাগের কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রফতানির অর্থমূল্যের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঝুটসহ কাঁচা তুলা আমদানি হয়েছিল ৭৯ কোটি ৯২ লাখ ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে আমদানি হয় ১৬৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের এ পণ্যটি। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে তুলা এসেছে ১৮০ কোটি ডলারের। ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে পরের অর্থবছরে বাংলাদেশে ভারতীয় চিনি আমদানি বেড়েছিল ৬৫৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবশ্য চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্যদ্রব্যের আমদানি কমেছে ২৮ শতাংশ। ভারত থেকে বাংলাদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে গম আমদানি বেড়েছিল ২৮৪ শতাংশ। অন্যান্য খাদ্যশস্য আমদানি বেড়েছিল ২৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্যশস্য ৪৪ দশমিক ২৭ শতাংশ কম আমদানি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারত থেকে সড়কপথে আনা পণ্য এলসি (ঋণপত্র) খোলার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এদেশে পৌঁছানো সম্ভব। একই পণ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে দেশে পৌঁছাতে জাহাজের বিকল্প নেই। এতে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। সিঙ্গাপুর থেকে এক টন পণ্য আমদানিতে ৩০ থেকে শুরু করে ৫০ ডলার পর্যন্ত ব্যয় হয়। একই পণ্য যদি ভারত থেকে আমদানি করা যায় তবে টনপ্রতি ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ ডলারের বেশি খরচ হয় না। আবার সড়কপথে পণ্য আমদানিতে পণ্যের পরিমাণ নিয়েও ভাবতে হয় না ব্যবসায়ীদের। অর্থাৎ ট্রাকে করে পণ্য আমদানির সুযোগ থাকায় যেকোনো পরিমাণ পণ্যই আমদানির সুযোগ থাকে। তাছাড়া কৃষিপণ্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ দ্রুত পচনশীল কিংবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মান পরিবর্তন হয় বিধায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আনলে লোকসানের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এদেশের আমদানিকারক কিংবা ইনটেন্ডিং ব্যবসায়ীদের ভাষাগত স্বাচ্ছন্দ্যবোধও আমদানি বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রাখে।
ভারতীয় বাণিজ্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশে কৃষিজ পণ্য আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। মূলত এর পেছনে করোনাকালীন সংকট, পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক পণ্যবাজারের অস্থিরতা, শিপিং চার্জ বৃদ্ধি, জাহাজের শিডিউল বিপর্যয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। সেই সংকট কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যশস্যের বাজার অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। বিশ্ববাজারে প্রায় সব ধরনের কৃষিজ নিত্যপণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। জাহাজ ভাড়া প্রায় প্রতিদিনই বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। চাইলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতে পারেননি। এলসি খোলার পর পণ্য আমদানি দীর্ঘায়িত হওয়ায় ব্যাংকঋণের সুদ বেড়ে যাওয়াসহ একাধিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা তখন প্রতিবেশী দেশ ভারতকে বেছে নেন। সহজেই গম, চিনি, চালসহ প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য নিয়ে আসেন আমদানিকারকরা। তবে নিম্নমুখী রিজার্ভের কারণে ডলার সংকট থাকায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানিতে লাগাম টানে সরকার। এর প্রভাবে আমদানি কিছুটা কমে যায়। ভারত প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের অন্যতম বৈশ্বিক বাজার হওয়ায় দেশটি থেকে কৃষিপণ্য আমদানি অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের অন্যতম কৃষিজ পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে পণ্যের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য অনেকটাই সহজ। দ্রুত পচনশীল পণ্যগুলো যেমন আদা, রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, হিমায়িত খাদ্য দূরবর্তী দেশ থেকে সস্তায় কেনার চেয়ে প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানি করলে ব্যবসায়িক ঝুঁকি কমে যায়। সড়কপথের বাণিজ্য সুবিধাকে কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীরা বিগত কয়েক বছর ভারতের সঙ্গে আমদানি বাণিজ্যে বেশি জড়িয়েছে।’ বৈশ্বিক কৃষিজ বৃহৎ বাজারগুলোর সংকট চলমান থাকায় সর্বশেষ অর্থবছর কিংবা চলতি অর্থবছরেও বিগত বছরের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
মসলা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স অসীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী অসীম কুমার দাস এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক সময় চীন ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মসলা পণ্যের শীর্ষ রফতানিকারক ছিল। বর্তমান সময়ে ভারত থেকে প্রায় সব ধরনের মসলা পণ্য আমদানি হচ্ছে। রি-এক্সপোর্টসহ নানা সুবিধার কারণেও দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতও কৃষিজ পণ্যের অন্যতম দেশে পরিণত হচ্ছে।’ যার কারণে এদেশীয় আমদানিকারকরা নিজেদের সুবিধা বিবেচনায় ভারতের সঙ্গে আমদানি বাণিজ্য বাড়িয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
বাণিজ্য খাতের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় যোগাযোগ ও পণ্যের প্রাপ্যতা—এ দুই প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যে কিছুমাত্রায় ভারতনির্ভরতা রয়েছে বাংলাদেশের। গত অর্থবছরে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য, বিশেষ করে আমদানি কমায় ডলারের ওপর চাপ কিছু কমেছে। তবে সামগ্রিকভাবে বাণিজ্য কমার বিষয়টিকে ভালো বলা যাবে না। কেননা খাদ্যপণ্য আমদানি কমার অন্য প্রভাব রয়েছে। গত অর্থবছরে ভারত থেকে গম আমদানি করা যায়নি। ফলে কানাডা থেকে গম আমদানি করতে হয়। এতে দেশের বাজারে আটার দাম অনেক বেড়ে গেছে। তার আগের অর্থবছরে গমের একটা বড় অংশ ভারত থেকে এসেছিল বলে আটার দাম কম ছিল। ভারত থেকে চিনি আমদানিও কমেছে। আবার তুলা আমদানিও কমছে দামের কারণে। এই কমে যাওয়াটা আদতে ভালো নয়। কারণ তুলা আমদানির পর প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় রফতানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত থেকে আনতে না পারায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে দুইভাবে। প্রথমত, প্রাপ্যতা কমেছে। দ্বিতীয়ত, দূর দেশ থেকে আনতে গিয়ে দামের ওপর প্রভাব পড়েছে।
ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুধু কৃষি ও খাদ্যশস্য নয়, যেকোনো পণ্য আমদানির জন্য ভারত সবচেয়ে ভালো বিকল্প দেশ। আমদানি বাধাগ্রস্ত হলেও ভারত সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু নির্ভরশীল হয়ে গেলে তখন ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই অন্যান্য উৎস থেকেও আমদানির পরিকল্পনা রাখতে হবে। ভারতের বিকল্প অবশ্যই রাখতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে স্থল-নৌ-রেল অনেকগুলো মাধ্যম আছে বাণিজ্যের। আর বর্তমান বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার সংকটে দুই দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। তবে আগের খারাপ অভিজ্ঞতাও মনে রাখতে হবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ উইংয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তুলা বা গম—এগুলোতে আমরা আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে এগুলোর উৎপাদন খুব বাড়ানো সম্ভব নয়। এছাড়া সবজি, পেঁয়াজ, মরিচ—এসব সাধারণত পচনশীল হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে আমদানি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ পরিবহন খরচ কমে যায় এবং পণ্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কা কম থাকে।’ তিনি বলেন, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে কভিডের কারণে আমদানি কিছুটা কম হয়। এ তথ্য যদি আরো কয়েক বছর আগের পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করা যেত তাহলে মূল ধারণা পাওয়া যেত। আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণ মূলত কভিডের কারণে আগের অর্থবছরের চাপ পরের অর্থবছরে পড়েছে। এছাড়া গম ও অন্য পণ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অন্য দেশ থেকে কম এসেছে। ভারত থেকে তখন রফতানি বেড়ে যায়। তবে আমদানি করা যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন সম্ভব যেমন পেঁয়াজ, টমেটো—এগুলো দেশেই উৎপাদন করার ওপর জোর দিচ্ছি।’