গত বছরের ৩ অক্টোবর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আমিনবাজারে অনুষ্ঠিত এক শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নীতি নিয়ে কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। ওই সমাবেশে তিনি বলেন, ‘কোথায় নিষেধাজ্ঞা? কোথায় ভিসা নীতি? তলে তলে আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরা আছি। শত্রুতা কারো সঙ্গে নেই। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, এমন ভারসাম্য সবার সঙ্গে করে ফেলেছেন, আর কোনো চিন্তা নেই। নির্বাচন হবে, যথাসময়ে হবে।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন, যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রীর ওই বক্তব্য সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। শুধু সেবার নয়, বিভিন্ন সময়েই তার এসব মন্তব্য নিজ দলের কর্মী ও জনসাধারণের মধ্যে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তার বেশির ভাগ বক্তব্যই এখন ইউটিউব-ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোয় ভাইরাল হচ্ছে। অনেকটাই ‘ফ্যানডম’ (যখন একজন ব্যক্তি বা তার কর্মকাণ্ডকে অনেক মানুষ ফলো করে) গড়ে তুলেছেন ওবায়দুল কাদের।
অনেকেই বলছেন, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতির কৌশলগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেখান থেকে দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির বাস্তব ইঙ্গিতও মিলছে। এরই মধ্যে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নতুন সরকার গঠিত হলেও এখনো কোনো বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েনি। পশ্চিমারাও এখন পর্যন্ত কোনো বিধিনিষেধ বা স্যাংশন আরোপ করেনি।
গতকাল বিএনপিকে নিয়ে এক দলীয় অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপির এ মুহূর্তে কোনো আশা নেই। নিষেধাজ্ঞাও নেই, ভিসা নীতিও নেই। ভিসা নিষেধাজ্ঞার আশায় আশায় দিন চলে যায়, রাত পোহায়, এই হলো বিএনপি। নির্বাচন না করে বিএনপি যে ভুল করেছে, অচিরেই তা টের পাবে।’
ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক রাজনীতিতে এ পর্যায়ে উঠে এসেছেন তৃণমূল থেকে। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে শুরু করে এখন হয়ে উঠেছেন দেশের রাজনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সেবার তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০০০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ পদে ছিলেন তিনি। এ পদে থাকাকালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ মার্চ তিনি গ্রেফতার হন। ১৭ মাস ২৬ দিন কারাগারে ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন।
২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নোয়াখালী-৫ আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে চতুর্থ ও পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিগত সরকারের মতো এবারো তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি নিজ নির্বাচনী এলাকার রাজনীতিতেও সমান সক্রিয় ওবায়দুল কাদের। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আ ন ম সেলিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওবায়দুল কাদেরের রাজনীতির শুরু নোয়াখালী থেকেই। পরে তিনি জাতীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। নেতা হিসেবেও তিনি কর্মীবান্ধব। শুধু নোয়াখালী না, সারা দেশের আওয়ামী লীগের কর্মীদের খোঁজখবর তিনি রাখেন।’
২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে প্রথমবারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে ২১তম এবং ২০২২ সালে ২২তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি টানা তিন মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ওবায়দুল কাদেরের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাড. কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসছেন। ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ডাকসু নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তিন-তিনবারের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার কারণেই তিনি টানা তিন মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে টানা তিন মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন—এটা বিরাট যোগ্যতার বিষয়, চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এটা তার সাংগঠনিক যোগ্যতার বিষয়।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এ সদস্য বলেন, ‘সাংগঠনিক ব্যাপারে তার দক্ষতার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। সংগঠন দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। বিএনপির সন্ত্রাস মোকাবেলা করতে পেরেছি আমরা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের কর্মসূচিগুলো অত্যন্ত সফলভাবেই পালন করতে পেরেছি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশীদের রাষ্ট্রনীতি, ভিসা বা স্যাংশন প্রসঙ্গে তিনি আগাম যেসব কথা বলেছিলেন, সেগুলোই আসলে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। ভিসা স্যাংশন বা এগুলো কোনো কাজে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলকে কাজে লাগিয়ে এবং তার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করে সংগঠনকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী একজন সফল ও যোগ্য সহযোগী পেয়েছেন। আমরা একসঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি, তার সহযোগিতা পেয়েছি। একবার তিনি যখন ওয়ান-ইলেভেনে গ্রেফতার হন তখন আইনজীবী হিসেবে মামলা লড়ে তার পাশে ছিলাম। তখন তার মনোবল শক্তই দেখেছি।’
ওবায়দুল কাদেরের জন্ম নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড় রাজাপুর গ্রামে ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি। স্থানীয় বসুরহাট সরকারি এএইচসি হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি মেধাতালিকায় স্থান পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে ওবায়দুল কাদেরের বড় শক্তি হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একাত্তর-পরবর্তী সময়েই ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তিনি কখনো রাজনীতি থেকে নিজেকে বিরত রাখেননি। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে উনি নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। অভিজ্ঞতার আলোকেই উনি কথা বলেন।’
শিক্ষার্থী জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ওবায়দুল কাদের। ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সক্রিয় ছিলেন। ওবায়দুল কাদের একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুজিব বাহিনীর কোম্পানীগঞ্জ থানার কমান্ডার ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ওবায়দুল কাদের কারাবরণ করেন। আড়াই বছর তিনি কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। পরপর দুবার এ পদে ছিলেন তিনি। ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘ সময়। তিনি এ পর্যন্ত নয়টি বই লিখেছেন।
এর মধ্যে একবার প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। ২০১৯ সালের ২ মার্চ শ্বাসকষ্ট নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ওবায়দুল কাদের। সেখানে দ্রুত এনজিওগ্রাম করার পর তার হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিতে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। ভারতের বিখ্যাত চিকিৎসক দেবী শেঠি ঢাকায় এসে ওবায়দুল কাদেরকে দেখার পর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে ৪ মার্চ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ওবায়দুল কাদেরকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেয়া হয়। ২০ মার্চ ওই হাসপাতালে তার বাইপাস সার্জারি হয়। দুই মাস ১১ দিন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে ১৫ মে সন্ধ্যায় দেশে ফিরে আসেন। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং এখনো সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করে চলেছেন।
ওবায়দুল কাদেরের প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকা হালিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদীয়মান ছাত্রনেতা সেই সময় আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সেই সূত্রে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই আমি ওবায়দুল কাদেরকে চিনি। উনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা একদিনে তৈরি হয়নি। উনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। নোয়াম চমস্কি ও এডওয়ার্ড সাইদকে পড়েন। ফলে উনার রাজনৈতিক কূটকৌশল ও প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ভূরাজনীতি ও বৈশ্বিক রাজনীতির বিশ্লেষণ করেন। সমাজবিজ্ঞানে একটি কথা আছে, ‘পলিটিক্স ইজ আ কাইন্ড অব এন্টারটেইনমেন্ট’। একজন নেতাকে তার সামনে থাকা অসংখ্য মানুষকে এন্টারটেইন করতে হবে। অর্থাৎ মানুষকে কনভিন্স করতে হবে। তাদেরকে ফলোয়ার হিসেবে নিজের সঙ্গে রাখতে হবে এবং আস্থাভাজন হতে হবে। সেই জায়গায় ওবায়দুল কাদেরের যোগ্যতা স্বীকার করতেই হবে। উনার উপস্থাপনের একটি নিজস্ব একটি স্টাইল আছে। ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদের মধ্যে এক ধরনের স্টাইল দেখা যায়। ওবায়দুল কাদেরের ছাত্রজীবন থেকেই একটি স্টাইল ছিল। বয়সের পরিপক্বতার সঙ্গে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। উনি যেমন পাজামা-পাঞ্জাবি পরেন, তেমনি স্যুটও পরেন। এভাবে আধুনিক পোশাক পরিধানের মধ্য দিয়ে নিজেকে তিনি আধুনিক রাষ্ট্রের অংশ করে তোলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রজ্ঞাবান আশরাফ সাহেব যখন অকালেই হারিয়ে গেলেন সেখানে স্থলাভিষিক্ত হলেন ওবায়দুল কাদের। উনি রাজনৈতিকভাবে যে বক্তৃতা দেন বিশেষ করে এবারের জাতীয় নির্বাচনে, আমিও ভাবতাম যে উনি দূরদর্শিতা নিয়ে কথাগুলো বলছেন। সেই সময় উনার কথা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি যখন বলেছেন, সাধারণ সম্পাদকের পদকে ধারণ করে ও একজন পরিপক্ব রাজনীতিবিদ হিসেবে দায়-দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন। ওবায়দুল কাদেরের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আছে। যাদের সঙ্গে কথা বলছেন তাদের কথার মর্মার্থ বোঝার দক্ষতা উনার আছে। এর পাশাপাশি এটা তো বুঝতে হবে উনার ইমিডিয়েট বস হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উনার এগুলো এক্সচেঞ্জ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তো সব কথা বলবেন না। মুখপাত্র তো সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেক্ষেত্রে আমি বলব এটা একটা কালেক্টিভ অ্যাফোর্ট, যা উনার মাধ্যমে এসেছে।’