হঠাৎ বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য আবুধাবি-দুবাই

গোটা বিশ্বেই উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি বাংলাদেশেও। যদিও হঠাৎ করেই বাংলাদেশীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত কিউএস র্যাংকিংয়ে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান ১৫০-এরও পরে। তার পরও গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যকই গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবি ও দুবাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়।

গোটা বিশ্বেই উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি বাংলাদেশেও। যদিও হঠাৎ করেই বাংলাদেশীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত কিউএস র্যাংকিংয়ে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান ১৫০-এরও পরে। তার পরও গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যকই গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবি দুবাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নিয়ে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) সংস্থাটির সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইউএই। ২০২২ সালে ১১ হাজার ১৫৭ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন আবুধাবি দুবাইসহ ইউএইর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। সে হিসেবে গত বছর বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়া মোট শিক্ষার্থীর ২২ শতাংশই গেছেন ইউএইতে। যদিও এর আগে কখনই বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশীদের গন্তব্য হিসেবে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়ও ছিল না দেশটি।

ইউএইর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিপ্রণেতা মান নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান কমিশন ফর একাডেমিক অ্যাক্রেডিটেশন (সিএএ) সিএএর তথ্যমতে, বতর্মানে দেশটিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭০টি। এর মধ্যে সিংহভাগই আবুধাবি দুবাইয়ে। শারজাসহ অন্যান্য শহর বা অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটি। র্যাংকিং বা শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেক বাংলাদেশীই আবুধাবি-দুবাইয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু সম্প্রসারণ করেছেন। গড়ে তুলেছেন প্রপার্টি। তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যই সেখানে বসবাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন রেখে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন অন্তত ৪৫৯ বাংলাদেশী। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। আবার অনেকে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করে ইউএইর গোল্ডেন ভিসা নিয়েছেন। ব্যাংক পরিচালক, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারদেশের বড় মাঝারি এমন অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী।

বিশেষ কার্ডধারী বিত্তবানদের সন্তানরা ১০ বছরের রেসিডেন্সিয়াল সুবিধাসহ সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে এখন বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন। পাশাপাশি উন্নত দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই দুবাই-আবুধাবির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। মোটা দাগে বিষয়গুলোই এখন দুবাই আবুধাবিসহ আরব আমিরাতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উচ্চশিক্ষায় শীর্ষ গন্তব্যের পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলোর যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন অর্থনীতিবিদ-শিক্ষাবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, দুবাই-আবুধাবির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খরচ বেশি। আবার সেখানে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি বা স্কলারশিপ দেয়ার তেমন কোনো নজিরও দেখা যায় না। বিশ্বব্যাপী মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সুনাম অর্জন করতে পারেনি আরব আমিরাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর পরেও সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের গন্তব্য হয়ে ওঠার বিষয়টি দেশের আর্থিক অপরাধ খাতসংশ্লিষ্টদের মনোযোগের দাবি রাখে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক . মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, একসময় বাংলাদেশীদের অর্থ পাচার সেকেন্ড হোমের জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। তখন বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শিক্ষার্থী গমনও বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থ পাচার সেকেন্ড হোম নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুবাইয়ের নাম শোনা যাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে দেশটির উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ বাড়তে শুরু করল। তাই দুটি বিষয়ের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কের অবকাশ উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। যখন কেউ অর্থ পাচার করে বিদেশে নিয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই সবার আগে পরিবারকে সেখানে স্থানান্তর করে। ছেলেমেয়েকে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। আরেকটি বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বৃত্তির অর্থে পড়তে যায়। অন্যদিকে মালয়েশিয়া, দুবাই কিংবা আবুধাবির বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে, এমন কোনো বিজ্ঞপ্তি কখনো আমাদের দৃষ্টিতে আসেনি। অর্থাৎ দেশগুলোয় শিক্ষার্থীরা স্বঅর্থায়নে পড়তে যাচ্ছেন।

ইউনেস্কোর গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস শীর্ষক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান। বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্যের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর হাজার ৬৬৫ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ওই বছর বাংলাদেশ থেকে হাজার ১৮০ জন শিক্ষার্থী যান।

কয়েক বছর আগে আবুধাবি দুবাইয়ের মতো একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে। দেশটিতে গড়ে ওঠা কয়েক হাজার অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ২০১৪-১৫ সালের দিকে হঠাৎ করেই বাংলাদেশীদের উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য হয়ে ওঠে মালয়েশিয়া। যদিও পরবর্তী দুই-তিন বছরের মধ্যেই সেটা আবার নিম্নগামী হয়।

বিদেশে উচ্চশিক্ষায় পরামর্শসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী এমকে বাশার বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলাদেশী শিক্ষার্থী গমন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় ভূমিকা রাখছে। প্রথমত, সাম্প্রতিক সময়ে প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশী বিত্তবানরা দেশটিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন সম্পদ গড়ে তুলেছেন। অর্থ বিনিয়োগকারীদের পরিবারের সদস্যরা শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে সেখানে বিশেষ সুবিধা পান। কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিত্তবানরা তাদের সন্তানদের সেখানে পড়াচ্ছেন। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আরব আমিরাতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় উন্নত বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জয়েন্ট প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। দেখা যাচ্ছে, তারা চার বছরের প্রোগ্রাম দুই বছর দুবাইয়ে বাকি দুই বছর যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশে পড়ার সুযোগ দেয়। কারণে যেসব বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ফলাফল টিউশন ফিসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে না পেরে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন না, তারা আরব আমিরাতকে ট্রানজিট হিসেবে নিচ্ছেন।

২০২২ সালে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্যের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষার্থী গেছেন হাজার ৬৭৪ জন। আর পঞ্চম অবস্থানের দেশ কানাডায় গেছেন হাজার ১৩৬ জন। এছাড়া শীর্ষ ১০ গন্তব্যের বাকি দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিতে হাজার ৯৩০, যুক্তরাজ্যে হাজার ১৯৪, জাপানে হাজার ৮০২, ভারতে হাজার ৭৫০ দক্ষিণ কোরিয়ায় হাজার ১৭৬ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ওই বছর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে আরব আমিরাতে বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাত্ক্ষণিকভাবে কারো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরও