বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। মোট আবাদি জমির প্রায় ৭৫ শতাংশেই ধান ফলান কৃষক। তাদের প্রচেষ্টায় উৎপাদনের হারও বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। তবে সেচ, সার ও কীটনাশকসহ প্রায় সব ধরনের কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ কমেছে। ফলে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে কম প্রভাব ফেলছে ধান চাষাবাদ। দূর হচ্ছে না দরিদ্রতা। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন ফসল ও প্রাণিসম্পদ-সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের সঙ্গে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের হার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের হারকে বিবেচনায় নেয়া হয়। বিভিন্ন ফসল ও প্রাণিসম্পদ-সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, কন্দাল ফসল, উদ্যান ফসল, ডাল ও তেলজাতীয় শস্য, মাংস ও দুধ উৎপাদন এবং মৎস্য চাষ।
চলতি বছরের জুলাইয়ে আইএফপিআরআইয়ের ‘বাংলাদেশ এগ্রি ফুড সিস্টেম স্ট্রাকচার অ্যান্ড ড্রাইভার্স অব ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক দশকে (২০০৯-১৯) বাংলাদেশে জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ভুট্টা, পাট, মাংস ও দুধ উৎপাদন। এর পরই রয়েছে কন্দাল ফসল, উদ্যান ফসল, ডাল ও তেল শস্য উৎপাদন এবং মৎস্য চাষ। তবে কৃষকের জীবনমানে সবচেয়ে কম প্রভাব ফেলছে ধান উৎপাদন।
কৃষকের দরিদ্রতা কমিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখছে ভুট্টার চাষাবাদ। ক্রমান্বয়ে এর পরই রয়েছে কন্দাল ফসল বা আলু উৎপাদন, পাট, তেল ও ডাল শস্য, উদ্যান ফসল, ধান চাষাবাদ, মৎস্য এবং মাংস ও দুধ উৎপাদন। ক্ষুধার হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এগিয়ে আছে ভুট্টা। এরপর ধান, কন্দাল ফসল, তেল ও ডাল শস্য, পাট ও মৎস্য চাষ। তবে এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাণিসম্পদ-সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের ভূমিকা নেতিবাচক।
গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আইএফপিআরআইয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জিনশেন দিয়াও ও কার্ল পাউ, পরিচালক জেমস থার্লো, জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী অ্যাঙ্গা প্রদেশা ও জোসি র্যান্দ্রিয়ামঞ্জি এবং পলিসি মডেলিং ইউনিটের গবেষণা বিশ্লেষক মিয়া এলিস।
রুরাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি অ্যানালাইসিস (আরআইএপিএ) মডেলে (মোট স্কোর এক ধরা হয়) জীবনমান উন্নয়নে ভুট্টা ও পাটের স্কোর শূন্য দশমিক ৬৫, মাংস ও দুধ উৎপাদন শূন্য দশমিক ৩৯, কন্দাল ফসল শূন্য দশমিক ৩২, উদ্যান ফসল শূন্য দশমিক ৩১, ডাল ও তেল জাতীয় শস্য শূন্য দশমিক ১৯, মৎস্য চাষ শূন্য দশমিক ১৬ এবং ধান উৎপাদনের স্কোর হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১২। এছাড়া অন্যান্য প্রাণিসম্পদের স্কোর শূন্য দশমিক শূন্য ৫।
কৃষকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বেশি ভূমিকা রাখছে পাট। এর পরই ভুট্টা, কন্দাল ফসল, মাংস ও দুধ উৎপাদন, মৎস্য চাষ, ধান, উদ্যান ফসল এবং তেল ও ডাল শস্য উৎপাদন। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও পাট চাষাবাদ সবচেয়ে এগিয়ে। এর পরই রয়েছে ভুট্টা, তেল ও ডাল শস্য এবং উদ্যান ফসলের চাষাবাদ। তবে এক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকায় দেখা গেছে কন্দাল ফসল, মাংস ও দুধ উৎপাদন, ধান ও মৎস্য চাষ। খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণের দিক থেকে বেশি ভূমিকা রাখে মাংস ও দুধ উৎপাদন এবং উদ্যান ফসল বা সবজি চাষাবাদ। এর পরই ভুট্টা, তেল ও ডাল শস্য, পাট, মৎস্য চাষ, কন্দাল ফসল ও ধান। অর্থাৎ খাদ্য বা পুষ্টি গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম ভূমিকা রাখছে চাল।
নওগাঁ সদর উপজেলার বাঁচারি ইউনিয়নের কৃষক আহসান হাবিব ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষাবাদ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্যান্য ফসলের চেয়ে ধান চাষে লাভ কম। কিন্তু আমাদের ধান উৎপাদন করতে হবে। কীভাবে উৎপাদন ধরে রেখে কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন করা যায় সেটা সরকারসহ সবাইকে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের বিকল্প নেই। কৃষিযান্ত্রিকীকরণ করতে না পারলে ধান চাষকে লাভজনক করা যাবে না। যারা সত্যিকারের কৃষক তাদেরকেই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কীভাবে যন্ত্র দিয়ে মাড়াই, রোপণ ও কর্তন করতে হয় তা শেখাতে হবে। পাশাপাশি যন্ত্রের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা দরকার। আমাদের দেশের নারীরা কৃষিতে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু সরকারিভাবে যেসব প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেখানে নারীরা পিছিয়ে। এক্ষেত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্ত ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে অল্প টাকায় ধান উৎপাদন সম্ভব। এতে কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব হবে।’
দেশের চাল উৎপাদনে এগিয়ে থাকা বেশির ভাগ জেলায়ই দারিদ্র্যের হার বেশি। তারা খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়ও বেশি ভোগেন। বিবিএসের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলোর শীর্ষে রয়েছে কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জামালপুর, মাগুরা, কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এসব জেলায় ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্য হারের উচ্চরেখায় অবস্থান করছে। যদিও শুধু খাগড়াছড়ি জেলা ব্যতীত অন্য সব জেলায়ই চাল উৎপাদন হয় চাহিদার চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার কৃষকের গোলায় ধান রাখার জন্য একটা নির্ধারিত মূল্য অগ্রিম দিয়ে রাখবে। এক্ষেত্রে কৃষক যদি ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে না পারেন তাহলে সরকার সে মূল্য নিশ্চিত করবে। সার ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। এগুলোয় ভর্তুকি বাড়াতে হবে। আরেকটা শঙ্কার বিষয় হলো যারা কৃষক তাদের ছেলে-মেয়েরা কৃষিতে থাকতে চাইছে না। শহরের দিকে চলে আসছে। সীমিতসংখ্যক হয়তো উদ্যোক্তা হচ্ছে। কিন্তু কৃষককে ধান উৎপাদনে ধরে রাখতে হবে। এজন্য ভর্তুকি বা সুবিধা দিয়ে ধানকে লাভজনক ফসল হিসেবে কৃষককে দিতে হবে। এর পাশাপাশি অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি সহায়তা দিতে হবে যেন কৃষকের লাভ হয়, অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু কৃষকের হাতে সেভাবে প্রযুক্তি তুলে দিতে পারিনি। জাপান এত কিছুর পরও ধানে ভর্তুকি দিচ্ছে। আমাদের দেশেও মৌলিক বিষয়গুলোয় নজর দিতে হবে। যত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো দূর করতে ভূমিকা নিতে হবে।’
কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। পশু ও মৎস্য খাদ্যের উপকরণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ভুট্টার। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ভুট্টার চাহিদা বেড়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ভুট্টার দামও ভালো পাচ্ছেন কৃষকরা। তবে যারা শুধু ধান চাষ করছেন তারা উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় খুব বেশি লাভ করতে পারছেন না। সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যে খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয় কৃষকের। ফলে তারা কম মূল্যে খোলাবাজারে ধান বিক্রি করে দেন।
এসিআই এগ্রো লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. এফ এইচ আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভুট্টায় প্রতি হেক্টরে ৮ থেকে ১৪ টনের মতো উৎপাদন হয়ে থাকে। এতে উৎপাদন খরচ কম। আবার বাজারে দামও ভালো। ফলে এখানে কৃষক আয় করতে পারেন বেশি। আলুর ক্ষেত্রেও এবার দাম ভালো ছিল। ফলনও ভালো হয়েছে। পাটের দাম ভালো কিন্তু এটা এখন আবহাওয়াগত কারণে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। যারা ধান উৎপাদন করে তারা বেশি লাভ করতে পারে না। ধানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম। দাম হ্রাস-বৃদ্ধি খুব বেশি ঘটে না, স্থির থাকে। যারা নিম্নমানের কৃষক তারাই শুধু ধান চাষ করছেন। তবে অনেকে ধানের পাশাপাশি অন্যান্য লাভজনক ফসলও চাষাবাদ করছে। তাদের জীবনমান উন্নয়ন হচ্ছে।’
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধান উৎপাদনে কৃষককে ধরে রাখতে কৃষি উপকরণে ভর্তুকি ও প্রণোদনার পরিমাণ বাড়াতে হবে। সার, বীজ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে কৃষককে প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা বাড়াতে হবে। ধানের উৎপাদন ধরে রেখে লাভজনক ফসলেও কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে যেন কৃষক আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকেন। তা না হলে ভবিষ্যতে কৃষককে কৃষিতে ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যারা শুধু ধান চাষ করেন তাদের জীবনমান দুর্বল হতে পারে। আমাদের মূল খাদ্যশস্য ধান। অনেক এলাকা আছে যেগুলোয় ধান ছাড়া বিকল্প নেই। যেমন হাওর ও বিল এলাকা। এক্ষেত্রে সার, কীটনাশক, শ্রমিক খরচসহ উৎপাদন খরচ মিলিয়ে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। কিন্তু অন্যান্য ফসল যারা চাষ করছেন তাদের লাভ বেশি হচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা ধানের ওপর জোর দিচ্ছি। প্রণোদনা দেয়া ও ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষককে উৎপাদনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। গোলাভরা ধান থাকলে কৃষক একধরনের স্বস্তির মধ্যে থাকছেন। ধানচাষীরা খুব খারাপ আছেন তা বলা যাবে না, তবে অন্য ফসলের চেয়ে হয়তো কম লাভ করছেন। তবে যারা ধানের সঙ্গে অন্য ফসল চাষ করছেন তারা কিন্তু ভালো আয় করছেন। এক্ষেত্রে সরকার কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে।’