গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসাসেবা বিতরণের প্রথম স্তর হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রান্তিক পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে গাইবান্ধায় ৩১৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। তবে সুবিধাভোগীদের অভিযোগ, প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা তারা পাচ্ছেন না। কারণ বিভিন্ন সময় স্থাপিত এসব ক্লিনিকের অধিকাংশ ভবন এখন জরাজীর্ণ। চাহিদা অনুপাতে ওষুধ মিলছে না। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত অফিস করেন না।
স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রসবপূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসবপরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা দেয়া হয় এসব ক্লিনিকে। এছাড়া যক্ষ্মার প্রতিষেধক টিকাদান, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার বিধান রয়েছে। ক্লিনিকগুলোয় অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিসংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণসহ বিনামূল্যে ৩০টিরও বেশি ওষুধ সরবরাহ করার কথা। শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহে ছয়দিন সিএইচসিপির কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থাকার কথা। স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবার কল্যাণ সহকারীরা সপ্তাহে তিনদিন করে কমিউনিটি ক্লিনিকে বসার নিয়ম রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গাইবান্ধায় ত্রিমুখী সংকটে ধুঁকে ধুঁকে চলছে প্রান্তিক পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র। ক্লিনিকগুলোর অধিকাংশই জরাজীর্ণ। কোনোটির ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। বর্ষাকালে ওইসব ক্লিনিকে বসে সেবা নেয়া সম্ভব হয় না। আবার কোনোটির পলেস্তারা খসে পড়েছে। সিএইচসিপিরা সপ্তাহে দুই-তিনদিনের বেশি আসেন না। সকাল ১০টা-১১টায় এলেও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ক্লিনিক বন্ধ করে চলে যান। ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, টিকাদান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করার কথা। তবে অব্যবস্থাপনার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
তবে গাইবান্ধা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, বেহাল ভবনগুলো মেরামতের জন্য তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তদারকিও জোরদার করা হয়েছে।
গাইবান্ধা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে ৩১৯টি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৫৩টি, সাঘাটায় ৪২টি, ফুলছড়িতে ২২টি, সাদুল্যাপুরে ৩৯টি, সুন্দরগঞ্জে ৬২টি, পলাশবাড়ীতে ৩৩টি ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ৬৮টি। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৩১৬টিতে সিএইচসিপি রয়েছেন। প্রতিটি ক্লিনিক সপ্তাহে ছয়দিন খোলা থাকার কথা এবং সিএইচসিপির পাশাপাশি তিনদিন করে একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও একজন পরিবার পরিকল্পনা সহায়কের সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের কথা।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সরজমিনে সদর উপজেলার বাদিয়াখালী ইউনিয়নের ফুলবাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেছে, সেবাপ্রত্যাশীরা বেশির ভাগই নারী। সেখানে সিএইচসিপিকে নিয়মিত দেখা না গেলেও একই ক্লিনিকের অন্য একটি কক্ষে চিকিৎসা দেন বাদিয়াখালী উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র-২-এর উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডা. জাকির হোসেন। বাদিয়াখালী উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিজস্ব ভবন না থাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি কক্ষে চিকিৎসা দেন তিনি। ক্লিনিকে সেবা ও ওষুধ না পেলেও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সেটি পান বলে জানিয়েছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।
স্থানীয় বাসিন্দা হোসেন আলী জানান, ভবনটি পুরনো হওয়ায় অনেক জায়গায় ফাটল ধরেছে। এটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির দিন ভেতরে পানি পড়ে। তখন স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে বসে ওষুধ দেয়। ভবনটি দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন। তা না হলে কোনো একদিন ভেঙে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
একই উপজেলার চকবরুল কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও নারী সেবাপ্রত্যাশী বেশি। সিএইচসিপির কাছে সমস্যার কথা বলে ওষুধ নিচ্ছেন তারা।
তবে সেবা নিতে আসা সাধনা রানীসহ কয়েকজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণ অসুখ-বিসুখ হলে ক্লিনিক থেকে ওষুধ নিই। তবে সব ওষুধ পাওয়া যায় না।’ তাদের দাবি সরকার ওষুধের বরাদ্দ বাড়ালে তাদের জন্য ভালো হতো।
এ ব্যাপারে চকবরুল কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মমিনুল ইসলাম সজীব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে আমাদের ২৭ প্রকার ওষুধ দিত। এখন সাত প্রকার কমিয়ে ২০ প্রকার ওষুধ দিচ্ছে। সেগুলো দিয়েই আমরা প্রাথমিক সেবা দিচ্ছি।’
এ বিষয়ে গাইবান্ধা সিভিল সার্জন ডা. কানিজ সাবিহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার মান আরো বাড়ানোর জন্য নিয়মিত তদারকি জোরদার করা হয়েছে। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় ওষুধ ঘাটতি নেই। আগামীতে অ্যান্টিবায়োটিকের যে ওষুধগুলো আছে, এগুলো আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকে দেব না। কারণ আমাদের সিএইচসিপিরা চিকিৎসক নন। আমি কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছি। কিছু জরাজীর্ণ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটির অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। এটা সরাসরি আমাদের মাধ্যমে হয় না। এটার জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে রয়েছে। তারা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সব ভবন নির্মাণের কাজ করে। নতুন ভবন নির্মাণে দপ্তরটিতে চাহিদাপত্র দেয়া রয়েছে। মূলত ২০১০ সালের পর যে ক্লিনিকগুলো নির্মাণ হয়েছে, সেগুলোর কিছু কিছুর অবস্থা খারাপ। সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আমাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, প্রতি বছর পর্যায়ক্রমে নতুন যে কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি হচ্ছে, পুরনোগুলোও সেভাবে তৈরি করা হবে।’