সাধারণ বিসিএস

জীবনের বড় সময় চলে যায় প্রস্তুতিতেই, নিয়োগে চূড়ান্ত সুপারিশ পায় গড়ে মোট প্রার্থীর আধা শতাংশ

দেশের চাকরিপ্রার্থীদের পছন্দের শীর্ষে এখন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ থেকে শুরু করে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয় চাকরিপ্রার্থীদের।

দেশের চাকরিপ্রার্থীদের পছন্দের শীর্ষে এখন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ থেকে শুরু করে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয় চাকরিপ্রার্থীদের। যদিও সাধারণ বিসিএসে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের অংশ হওয়ার সুযোগ পায় গড়ে মোট প্রার্থীর আধা শতাংশের মতো। গত সপ্তাহেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে বিসিএসের পেছনে প্রার্থীদের ব্যয়কৃত সময়ের পরিমাণ আরো বাড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এখন পর্যন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া সর্বশেষ পাঁচ বিসিএস পরীক্ষার (৩৯ থেকে ৪৩তম) মধ্যে তিনটি ছিল সাধারণ ও দুটি ছিল বিশেষ বিসিএস। এর মধ্যে ৩৯ ও ৪২তম বিসিএস ছিল শুধু চিকিৎসকদের জন্য, যার উদ্দেশ্য ছিল সহকারী সার্জন পদে নিয়োগ দেয়া। আর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ২৬টি ক্যাডারে নবম গ্রেডের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য আয়োজন করা হয় ৪০, ৪১ ও ৪৩তম সাধারণ বিসিএসের।

বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। আগ্রহীদের বড় একটি অংশকে স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকেই এর প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির পর সাধারণ বিসিএসের ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হতে সময় লেগে যায় তিন বছরেরও বেশি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৪০তম সাধারণ বিসিএস আয়োজনের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। এতে অংশগ্রহণকারী যোগ্য আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ওই বিসিএসে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ হয় ৩ বছর ৬ মাস ২০ দিন পর ২০২২ সালের ৩০ মার্চ। এতে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন ১ হাজার ৯৬৩ জন, যা মোট অংশগ্রহণকারীর দশমিক ৪৮ শতাংশ।

এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বরে ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এর সুপারিশপ্রাপ্তদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হতে সময় নেয়া হয় ৩ বছর ৮ মাস ৭ দিন। ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট প্রকাশিত এ তালিকা অনুযায়ী এতে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছেন মোট অংশগ্রহণকারীর (৪ লাখ ৪ হাজার ৫১৩ জন) দশমিক ৬২ শতাংশ। সুপারিশপ্রাপ্তের সংখ্যা ২ হাজার ৫২০। একইভাবে ২০২০ সালের নভেম্বরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশকৃতের তালিকা প্রকাশে সময় লেগেছে তিন বছরেরও বেশি। এতে সুপারিশ পায় মোট অংশগ্রহণকারীর (৪ লাখ ৪২ হাজার ৮৩১ জন) দশমিক ৪৯ শতাংশ (২ হাজার ১৬৩ জন)।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিসিএসে যারা অংশ নেন তাদের বড় একটি অংশ দীর্ঘদিন শুধু এ পরীক্ষার প্রস্তুতিতেই পার করেন। এমনকি অনেকে প্রস্তুতির স্বার্থে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর চাকরি বা কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়া থেকেও নিজেদের বিরত রাখেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অতিক্ষুদ্র একটি অংশ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি প্রশাসনে যুক্ত হতে পারে। বাকিদের জন্য পুরো সময়টাই অপচয় হয়। সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এতে অনেকের নিষ্ফল সময় ব্যয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ঢালাওভাবে শিক্ষার্থীরা বিসিএসে অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশেরই সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে। বিসিএসে না টিকতে পারলে অনেকে অন্য চাকরিতে যুক্ত হতে পারতেন। যে বয়সে একজন ব্যক্তি রাষ্ট্র বা সমাজকে সার্ভিস দেবেন, ডেলিভারি দেবেন, নিজে উপার্জন করবে সে সময়টা তারা পরীক্ষা দিতে দিতেই পার করে ফেলছেন। চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হলেও বাস্তবতা হলো বয়স বেশি হলে পরীক্ষায় ভালো করা যায় না। আর বারবার পরীক্ষা দিলে প্রার্থীদের সময় অপচয়। পিএসসিরও প্রচুর খরচ আছে।’

তিনি বলেন, ‘সবার সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার দরকার নেই। সবার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার দরকার নেই—এ বোধটা জরুরি। কারণ সব জায়গায়ই মেধাবীদের প্রয়োজন আছে। এজন্য নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন।’

অনেকটা একই বক্তব্য পিএসসির সাবেক সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনেরও। তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট চাকরির জন্য বারবার চেষ্টার প্রবণতা রয়েছে। ফলে তাদের অন্য যেসব জায়গায় সুযোগ ছিল বা যেখানে তারা নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারতেন, সেগুলো সম্ভব হচ্ছে না।’

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে বিসিএসের আগ্রহ এতই প্রবল যে সিংহভাগই সময় অপচয়ের বিষয়টি আমলে নেন না। দীর্ঘ সময় প্রস্তুতি নেয়ার পর বিশেষ ছাড়া প্রতিটি বিসিএসেই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্নে তিন বছরেরও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। আবার বিসিএসের প্রক্রিয়াটি এমন যাতে কম বয়সীরাই ভালো করেন বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত বিসিএসগুলোয় দেখা গেছে যে যাদের বয়স ২৪-২৭ বছর তারাই ভালো করছেন। এর চেয়ে বেশি বয়সীদের ভালো করার হার কম। আর ২৯ বছরের ওপরের ক্ষেত্রে তা একেবারেই নগণ্য। আমাদের বিসিএসের প্রক্রিয়াটিই স্মরণশক্তিনির্ভর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বোঝার সক্ষমতা বা স্মরণশক্তি কমে যায়। ফলে তুলনামূলক বয়স্ক প্রার্থীদের জন্য সরকারি চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর যে ইতিবাচক পরিবর্তন পাওয়া যাবে, সেটিও বলা যায় না।’

বিশেষ বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তুলনামূলক কম সময়ে। এতে মোট প্রার্থীর মধ্যে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তের হারও তুলনামূলক বেশি। প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া সর্বশেষ পাঁচ বিসিএসের মধ্যে দুটি ছিল বিশেষ ৩৯ ও ৪২তম। এগুলো আয়োজন করা হয় সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক নিয়োগের জন্য। এর মধ্যে ৩৯তম (বিশেষ) বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল। ওই বিসিএসে ৩৭ হাজার ৫৭৬ আবেদনকারীর মধ্যে ৬ হাজার ৭৯২ জন নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পান। দুই দফায় চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়ায় সময় লেগেছে এক বছরের কিছু বেশি। আর ৪২তম (বিশেষ) বিসিএসে গোটা প্রক্রিয়ায় সময় লেগেছে ১০ মাসের কিছু বেশি। এতে ৩১ হাজার ২৬ জনের মধ্যে চার হাজার প্রার্থী চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন।

আরও