চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ২৯টি জেলেপল্লীতে নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ২ হাজার ৫৫৭ জন। সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। মাছের প্রজনন বাড়াতে ও বেড়ে ওঠা নির্বিঘ্ন করতে বছরের বিভিন্ন সময় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। তার পরও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মিলছে না। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০২০-২৩ সাল পর্যন্ত ইলিশ আহরণ কমেছে ২৫ শতাংশ। চলতি বছর ১২ অক্টোবর পর্যন্ত আহরণ হয়েছে ৫৬ টন। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আরো ৪৪ টন ইলিশ আহরণ হতে পারে।
জেলে ও স্থানীয়রা বলছেন, চার বছরে বদলে গেছে মিরসরাইয়ে ইলিশ আহরণের চিত্র। ইলিশের মৌসুম চললেও সাগর থেকে যেন মাছ উধাও হয়ে গেছে। উৎপাদন বাড়াতে সরকার বছরে একাধিকবার সাগর ও নদীতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও সে অনুপাতে ইলিশ মিলছে না। সাগরপারে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠায় ইলিশ আহরণ কমেছে। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সবক’টি কারখানা চালু হলে আহরণ আরো উল্লেখযোগ্য হারে কমবে বলে ধারণা তাদের।
এ ব্যাপারে মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মিরসরাইয়ে ইলিশ আহরণের চিত্র হতাশাজনক। আগে যেভাবে উপকূলে ইলিশ পাওয়া যেত, এখন সেভাবে পাওয়া যায় না। এর প্রধান কারণ উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে ঘাটগুলো বদলে ফেলায় ইলিশ আহরণ কমেছে। ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে আমরা নিষেধাজ্ঞার সময়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত করছি। চলতি বছর সব মিলয়ে ১০০ টন ইলিশ আহরণ হতে পারে।’
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মিরসরাইয়ে জেলেপল্লী রয়েছে ২৯টি। সেখানে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২ হাজার ৫৫৭ জন। ২০১৬ সালের আগে ২ হাজার ২৬ জন জেলে নিবন্ধিত হন। ২০২১ সালে নিবন্ধিত হন আরো ১০০ জন। পরবর্তী বছরগুলোয় নিবন্ধন পান আরো ৪৩১ জন জেলে।
মা-ইলিশ রক্ষা ও নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে নদী ও সাগরে মাছ শিকারে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে ১৩ অক্টোবর থেকে। ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, মজুদ ও বিপণন বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে জেলজরিমানার বিধান রয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও টাস্কফোর্স বিভিন্ন সময় অভিযানও পরিচালনা করছে। নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে নিবন্ধিত প্রত্যেক জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল দেয়ার কথা।
এ ব্যাপারে উপজেলার দক্ষিণ মায়ানী এলাকার বাবুল জলদাশ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইলিশ এখন সোনার হরিণ। সাগর ও নদী দূষণ বেড়ে গেছে। তাই ইলিশ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি ভরাটকাজে বড় বড় ড্রেজার ব্যবহৃত হওয়ার কারণেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।’
উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, মিরসরাইয়ে ২০২০ সালে ইলিশ আহরণ হয় ৩২৭ দশমিক ৪ টন। তবে ২০২১ সালে এসে ইলিশ আহরণে ধাক্কা খান এখানকার জেলেরা। ওই বছর ইলিশ আহরণ হয় ২৫২ দশমিক ৩ টন। ২০২২ সালে আহরণ হয় ১৪৭ দশমিক ৪ টন। এভাবে প্রতি বছরই কমতে থাকে ইলিশ আহরণ। তবে সে ধাক্কা আর সামাল দিতে পারেননি ২৯টি জেলেপল্লীর কয়েক হাজার জেলে। ২০২৩ সালে আহরণ কমে দাঁড়ায় ১১৬ টনে। চলতি বছর ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ হয়েছে মাত্র ৫৬ টন। ধারণা করা হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা শেষে আরো ৪৪ টন যোগ হলে আহরিত ইলিশের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১০০ টন।
এদিকে সাগরে ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে অনেকটা বিপাকে পড়েছেন জেলেরা। সরকারের তরফ থেকে যে সহায়তা দেয়া হয় তাতে সংসার চলে না বলে জানান তারা।
মায়ানি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের জেলে রণজিৎ জলদাশ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ছয় সদস্যের সংসার আমার। মৌসুম এলে দাদনে জাল কিনতে হয়। পরে ইলিশ আহরণ করে দাদনের টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ায় দাদনের টাকা পরিশোধ করতে এনজিও থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এছাড়া বছরে দুবার মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে।’