চলতি বছর নড়াইলে কয়েক দফা ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার মাছের ঘের ও পুকুর। মৎস্য খাতের পাশাপাশি ক্ষতি হয়েছে কৃষিতেও। কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, শুধু মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৯০ কোটি টাকা। আর বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে আরো ১০ কোটি টাকা।
প্রায় আট লাখ মানুষের বাস নড়াইলে। বিল ও ঘেরবেষ্টিত এ জনপদের মানুষের প্রধান জীবিকার উৎস কৃষি ও মৎস্য চাষ। এ জনপদের ৮২ শতাংশ মানুষই কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, গমসহ বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি অন্তত ৫০ হাজার মানুষ মৎস্য চাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
নড়াইল শহরের মো. আহাদউজ্জামান এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত। পৌর এলাকার ভওয়াখালী বিলে তিনটি ঘের রয়েছে তার। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ করে এ বছরও মাছ চাষ শুরু করেছিলেন তিনি। টানা বৃষ্টিতে তার তিনটি ঘের তলিয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে ঘেরের পরের বিভিন্ন ধরনের সবজি। এরই মধ্যে প্রান্তিক এ ব্যবসায়ী ৬ লাখ টাকা খরচ করেছেন। ভেবেছিলেন অন্তত ১০ লাখ টাকা লাভ হবে। তবে তার সেই স্বপ্ন নিমিষেই বিলীন হয়ে গেছে। ঋণ করে মাছ ছাড়লেও সব বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে। সমিতির ঋণের টাকা আর মাছের খাবারের দোকানের বাকি কীভাবে শোধ করবেন, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় এ ব্যবসায়ী।
কৃষক ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, জেলার বিল ও ঘের অঞ্চলের প্রতিটা এলাকার মাছচাষী ও কৃষকের একই অবস্থা। চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, খেতের ফসল, সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। বিপাকে পড়েছেন নড়াইল সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার কয়েক হাজার মাছ ব্যবসায়ী ও কৃষক। তিন দফা ভারি বর্ষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নড়াইল সদর ও কালিয়া উপজেলার চাষীরা।
পৌর এলাকার দুর্গাপুর গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী জিরু শেখ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘেরে মাছ চাষ করছি। বৃষ্টিতে এত ক্ষতি আগে কখনো হয়নি। সাড়ে তিন একর জমিতে দুটি ঘেরে যত মাছ ছিল, সব ভেসে গেছে। অন্তত ৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার।’
একই গ্রামের আরেক ব্যবসায়ী আজিজুর শেখ বলেন, ‘পাঁচটি ঘেরের মধ্যে চারটিরই মাছ ভেসে গেছে। ঘেরপারের সব সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আমার ৮ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।’
মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ঘের রয়েছে ৫ হাজার ৩০০টি। বৃষ্টির পানিতে এ অঞ্চলের ৬৩ শতাংশ ঘের তলিয়ে গেছে। এ জনপদে মাছচাষী রয়েছেন ১০ হাজারের বেশি। এছাড়া এ পেশার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত রয়েছেন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। মাছচাষীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর ৩৩ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৯০ কোটি টাকা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচএম বদরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষীদের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সহযোগিতা করা হবে। তবে বরাদ্দ না পেলে আর্থিকভাবে সহযোগিতার কোনো সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীরা যাতে আগামীতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সেজন্য মাঠ পর্যায়ে তাদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন মাঠ কর্মীরা।’
কৃষি বিভাগ বলছে, আমন ধান, ঘেরপারের শিম, কুমড়া, শসা, পেঁপেসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বৃষ্টিতে এ জনপদে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে শতকোটি টাকা।
কৃষক খাজা মিয়া জানান, বিল আর ঘের চেনার উপায় নেই। সব পানিতে তলিয়ে গেছে। একই কথা বলেন আড়পাড়া গ্রামের কৃষক তজিবর শেখ। তার দাবি, যেসব জমিতে হেঁটে চলাচল করা যেত, সেসব জমিতে নৌকা ছাড়া চলাচল করা যাচ্ছে না। জমির কোনো ফসল অবশিষ্ট নেই, সব নষ্ট হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নড়াইল খাদ্য ও মৎস্য চাষে উদ্বৃত্ত জেলা। প্রায় আট লাখ মানুষের জন্য মাছের চাহিদা রয়েছে ১৬ হাজার টন। প্রতি বছর উৎপাদন হয় অন্তত ১৮ হাজার টন মাছ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্তত ২ হাজার টন মাছ উদ্বৃত্ত থাকে। আর প্রতি বছর চাহিদা মিটিয়ে অন্তত এক লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে এ জনপদে।
এ বিষয়ে নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আশেক পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা করা হয়েছে। তাদের মাঝে সরকারিভাবে বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করা হবে। আশা করছি, সার ও বীজ সরবরাহ করা হলে কিছুটা হলেও তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।’