বাংলাদেশের যেসব এলাকায় এশিয়ান হাতির বিচরণ দেখা যায় এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্যতম। পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাতির বিচরণ দেখা যায় রাঙ্গামাটিতে। বিভিন্ন কারণেই মানুষের সঙ্গে হাতির দ্বন্দ্ব বেড়েছে। ২০০০ সালের পর দুই দশকের অধিক সময়ে কেবল রাঙ্গামাটি জেলায় হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বে ৪৮ জনের প্রাণ গেছে। আবার এই সময়ে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে এসে মৃত্যু হয়েছে ১০ হাতির।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বন উজাড়ের ফলে সৃষ্ট খাদ্য সংকট এবং হাতির চলাচলের করিডোরে মানুষের উপস্থিতি ও বসতি গড়ে তোলার ফলে হাতি-মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে। এ দ্বন্দ্বের কারণে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন হাতির আক্রমণে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল ও খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বন বিভাগের উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
অবশ্য বন কর্মকর্তারা বলছেন, হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে বন বিভাগের। নির্বিচারে বন উজাড়, হাতির করিডোরে মানুষের বসতি স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বনে খাদ্য সংকট, সুপেয় পানির সংকটসহ নানা কারণেই হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। পাহাড়ে বিপন্ন এশিয়ান হাতি রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে হাতির প্রতি ভয়কে জয় অর্থাৎ হাতিভীতি দূর করার তাগিদ দিয়েছেন বন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. নূরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাতি রক্ষায় জনমনে ভীতি দূর, হাতির বসবাসের স্থানে রাস্তাঘাট-বসতি নির্মাণ বন্ধ, হাতির করিডোর এবং আবাসস্থল নষ্ট না করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয়; তাই সারা বছর যাতে খাদ্য সংকট নিরসন করা যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন বিভাগ রাঙ্গামাটি অঞ্চলের অধীনে ছয়টি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি বন বিভাগ ও অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল বনীকরণ বিভাগের আওতাধীন পাহাড়ি এলাকায় হাতির বিচরণ দেখা যায় না। মূলত কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার ভাসান্যদম ইউনিয়নে মাহিতারা বেগম (৬৩) নামে এক বৃদ্ধা ও ২৭ ডিসেম্বর কাপ্তাইয়ে অংশে হ্লা মারমা (১৭) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে।
বন বিভাগের কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বিভাগটির রাইখালী রেঞ্জে শাবকসহ হাতি রয়েছে পাঁচটি। রেঞ্জটি হাতি-অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় বিভিন্ন সময় হাতির বিচরণ দেখা যায়। ২০০০ সালের পর রাইখালী রেঞ্জে হাতি মারা গেছে চারটি। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর হরিণছড়ায় একটি; ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর ডংনালায় একটি; গত বছরের ৬ মে সেলমারায় একটি এবং সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর মতিপাড়ায় আরেকটি হাতি মারা গেছে। এ সময়ে হাতির আক্রমণে ২১ জনের প্রাণহানি হয়েছে রাইখালী রেঞ্জে।
অন্যদিকে লংগদু উপজেলার ভাসান্যাদম ও খনমোর পর্যন্ত হাতির বিচরণ দেখা যায়। জেলার বরকল উপজেলার কুরকুটিছড়ি এবং বরুণাছড়ির বিভিন্ন এলাকায়ও হাতির বিচরণ দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকায় ১১টি হাতি ও একটি শাবক রয়েছে। তবে বাঘাইহাট রেঞ্জ, মাচালং রেঞ্জ, লক্ষ্মীছড়ি পূর্ব এবং পশ্চিম রেঞ্জ ও দীঘিনালা রেঞ্জের অন্তর্গত কাচালং সংরক্ষিত বনে হাতি বিচরণের তথ্য জানালেও সংখ্যা জানাতে পারেনি বন বিভাগ। ২০২১ সালের ১৪ জুন বরকল উপজেলার বরুণাছড়িতে একটি মৃত হাতির সন্ধান পাওয়া যায়; ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে জানা গেছে, হাতিটির মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। ২০০০ সালের পর থেকে এই বিভাগের অধীন বনাঞ্চলে আট ব্যক্তি হাতির আক্রমণে মারা গেছে।
ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের আওতাধীন এলাকায় হাতির বিচরণ তেমন একটা দেখা যায় না। ২০০৬-এ একবার এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে একবার কাশখালী রেঞ্জের কিছু এলাকায় হাতির বিচরণ দেখা গেছে। এ এলাকায় হাতির নিয়মিত বিচরণ না থাকায় মৃত্যুও নেই। ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের শামকুছড়িতে হাতির আক্রমণে মেশি মারমা নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের কাপ্তাই ও কর্ণফুলী রেঞ্জ হাতি-অধ্যুষিত হিসেবে বেশ পরিচিত। দুই রেঞ্জের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বর্তমানে শাবকসহ ছয়-সাতটি এশিয়ান হাতির উপস্থিতি রয়েছে। ২০১৬-১৮ পর্যন্ত এ এলাকায় তিনটি হাতির মৃত্যুর খবর জানিয়েছে বন বিভাগ। অন্যদিকে ২০০০ সালের পর থেকে দুটি রেঞ্জে ১৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এদের মধ্যে ছয়জনকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ দাবি করেছে বন বিভাগ। ২০১৫ সালের জুনে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার জীবতলীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুটি হাতির মৃত্যু হলেও বন বিভাগের তথ্যে এটি পাওয়া যায়নি। যদিও এলাকাটি দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন।
দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক গঙ্গা প্রসাদ চাকমা বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় জলাধার তৈরি করে পাহাড়ি ঝিরিতে ড্যামের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও হাতির জন্য শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রচার-সেমিনার, হাতির চলাচলের রাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে; যাতে মানুষ হাতি চলাচলের রাস্তায় সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে প্রাণীদের জন্য খাদ্য ঘাটতি নেই বলে মনে করেন উপ-বন সংরক্ষক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি হাতি প্রতিদিন গড়ে ১৬০-১৮০ কেজি খাবার খায়। কেবল কলা গাছই নয়, বাঁশসহ হাতির খাওয়ার উপযোগী প্রায় শত প্রজাতির গাছ, লতা-পাতা রয়েছে বনে। তবে শুষ্ক মৌসুমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে খরার প্রভাবে হাতি লোকালয়ে চলে আসে খাবারের সন্ধানে।’
ডিএফও রেজাউল বলেন, ‘বনের ক্ষতি যেসব জায়গায় হয়েছে; সেখান থেকে হাতি সরে যাচ্ছে। ভাসান্যাদম ইউনিয়নের আশপাশে যেসব এলাকায় খাবার ও সবুজ লতা-পাতা আছে সেখানে চলে আসছে হাতি। কাচালং রিজার্ভ ফরেস্টকে পুনরুজ্জীবত করার জন্য আমাদের একটি প্রকল্প সরকার ও বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট সংস্থার কাছে দেয়া আছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বনের ভেজিটেশন পুনরুদ্ধার হবে। হাতিও হয়তো লোকালয় ছেড়ে বনে ফিরবে।