নড়াইল পৌর এলাকায় কার্ড ও পণ্য বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপকারভোগীর দাবি, অধিকাংশ জায়গায় জনপ্রতিনিধিদের পছন্দের ও ধনী পরিবারের সদস্যরা পাচ্ছেন টিসিবির পণ্য। তালিকাভুক্ত কার্ডধারীরা জানিয়েছেন, প্রথমবার টিসিবি পণ্য নেয়ার পর তাদের কার্ড আর ফেরত দেয়া হয়নি। এখন কাউন্সিলররা তাৎক্ষণিক যাদের স্লিপ দিচ্ছেন তারাই পণ্য পাচ্ছেন। তালিকাভুক্ত নিম্ন আয়ের প্রতি পরিবারের জন্য একটি করে প্যাকেজ বরাদ্দ থাকলেও কাউন্সিলরদের পছন্দের লোকরা ১০-১২টি করে প্যাকেজ তুলছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অনিয়মে ক্ষুব্ধ হয়ে ভুক্তভোগীরা সম্প্রতি পৌরসভার মহিষখোলা এলাকায় কয়েক টিসিবির পণ্য বিক্রয় কর্মীকে মারধর করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্য স্বাভাবিক রাখতে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের সুবিধার্থে নিয়মিত স্বল্পমূল্যে কিছু ভোগ্যপণ্য বিতরণ করছে। ৫১ জন ভ্রাম্যমাণ ডিলারের মাধ্যমে জেলায় নিম্ন আয়ের ৪৫ হাজার ৫৯১ জন তালিকাভুক্ত ভোক্তা এসব পণ্য পাচ্ছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৩ হাজার ৮০, লোহাগড়া উপজেলায় ১০ হাজার ১০১, কালিয়া উপজেলায় ১১ হাজার ৭৮, নড়াইল পৌরসভায় ৫ হাজার ৫৬৭, কালিয়া পৌরসভায় ৩ হাজার ৮৫ এবং লোহাগড়া পৌরসভায় ২ হাজার ৬৮০ জন তালিকাভুক্ত কার্ডধারী রয়েছেন। এসব ভোক্তা রমজান মাসে দুই লিটার তেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি মসুরের ডাল এবং এক কেজি ছোলা পাচ্ছেন। যার মূল্য প্রতি লিটার তেল ১১০ টাকা, ১ কেজি ডাল ৬৫, চিনি ৫৫ এবং ছোলা ৪৫ টাকা।
সম্প্রতি নড়াইল পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের দুর্গাপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রখর রোদের মধ্যে প্রায় ৪০-৫০ জন লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন টিসিবির পণ্য নেয়ার জন্য। ট্রাকের পাশে বসে থাকা টিসিবির তালিকাভুক্ত গৃহিণী নিপা বেগম পণ্য পেয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে প্রথমবার টিসিবি পণ্য তোলার সময় ডিলার কার্ড নিয়ে যায়। তারপর আর মাল পাইনি, এবার ভোট চাইতে আসুক ভোট দিবানি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর ইপি রাণী বিশ্বাসের একটি স্লিপ দেয়ার কথা রয়েছে বলে বসে রয়েছি।’
একই সমস্যায় পড়া হাফিজুর রহমান (৬০), জামান শেখ (৫০), মিজানুর রহমান (৫০), ফিরোজা বেগম, মরিয়ম বেগমসহ অনেকে জানান, কার্ডের জন্য স্থানীয় কাউন্সিলর আনিচের কাছে গেলে তিনি কোনো সদুত্তর দেন না। বরং তিনি এখন তার পছন্দের ব্যক্তিদের স্লিপ দেন।
এ বিষেয়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আনিচুর রহমান বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের ১৫৭টি কার্ড ডিসি অফিস থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণে এখন স্লিপের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য দেয়া হচ্ছে। তবে অধিকাংশ মানুষই পণ্য পাচ্ছে। কিছু সমস্যা হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া কার্ডগুলোর নামের তালিকা পৌরসভায় রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু সময়ের অভাবে হয়ে উঠছে না। এখন গরিব থেকে বড় লোকরাই বেশি টিসিবি পণ্য নিচ্ছে। যার দোতলা পাকা বাড়ি রয়েছে তারাও মাল নিচ্ছে। বর্তমানে আমি স্লিপ দিচ্ছি না। এখন স্লিপ দিচ্ছেন ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর ইপি রাণী বিশ্বাস।’
তবে ইপি রাণী বলেন, ‘কাউন্সিলর আনিচ কাকে কীভাবে কার্ড দিয়েছেন তা জানি না। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি কাউকে কোনো কার্ড দিইনি।’
পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহিষখোলা এলাকার বাসিন্দা গৃহকর্মী তহুরন বেগম এবং পুরনো বাজার এলাকার মাসুম বিল্লাহ ও মুন্সি মিশন জানান, তারা প্রথমবার টিসিবি পণ্য নেয়ার সময় ডিলার কার্ড জমা নিলেও পরে আর সে কার্ড ফেরত পাননি। পরে স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কার্ড কিংবা পণ্য কোনোটাই পাননি।
রঘুনাথপুর-ডুমুরতলা ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর, বর্তমান জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর টিসিবি পণ্য নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় দিচ্ছেন, যাতে পণ্য সরাতে সুবিধা হয়। যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সুযোগ পাওয়া তালিকাভুক্ত ভোক্তার কার্ড অধিকাংশ কাউন্সিলর নিজের কাছে জমা রেখে এখন পছন্দের ব্যক্তিদের স্লিপের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য দিচ্ছেন। এটা এখন সবাই জানে।’ তবে এ বিষয়ে ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এজেড ইকবাল আলম বলেন, ‘পণ্য বিতরণে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টিসিবির এক ডিলার বলেন, ‘আমরা পণ্য দেয়ার পর স্থানীয় কাউন্সিলরদের কার্ড ও স্লিপ দিয়ে দেই। যদি কখনো কাউন্সিলররা কার্ড বুঝে না নেন তাহলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে কার্ড ফেরত দেই। মূলত কাউন্সিলররাই তাদের অপছন্দের ব্যক্তিদের কার্ড আউট করে দিয়ে পছন্দের লোকদের স্লিপ দিয়ে থাকেন। কখনো কখনো এক একজন ব্যক্তি ১০-১৫টি স্লিপ নিয়ে পণ্য নিতে আসে। এসব স্লিপধারীর অনেকেই সচ্ছল পরিবারের। কোনো গ্রাহক একটি বা দুটির বেশি কার্ড/স্লিপ আনতে পারবেন না, এ ধরনের নিয়ম থাকলে অনিয়ম কম হতো।’
আশিক এন্টারপ্রাইজের মালিক ময়েদ উদ্দিন জানান, গত ৪ এপ্রিল ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহিষখোলা ডায়াবেটিক সেন্টারের সামনে টিসিবি পণ্য বিক্রির সময় তার সাতজন বিক্রয় কর্মীকে স্থানীয় কয়েক যুবক কোনো কারণ ছাড়াই মারধর করে।
নড়াইল পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মলয় কুণ্ডু বলেন, ‘আমার কাছে টিসিবির নিম্ন আয়ের কার্ডধারী অনেকেই অভিযোগ করেছেন তারা টিসিবি পণ্য পাচ্ছে না। তাদের কার্ড এখন গায়েব হয়ে গেছে। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রকৃত কার্ডধারীদের টিসিবি পণ্য দেয়ার দাবি জানান।
এ বিষয়ে নড়াইল পৌর মেয়র আনজুমান আরা বলেন, ‘টিসিবির তালিকাভুক্ত কিছু ভোক্তার কার্ড হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনেছি। এ বিষয়ে কাউন্সিলররা আমাকে জানিয়েছেন, যাদের মূল কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না তাদের সবাইকে চিহ্নিত করতে না পারলেও পালাক্রমে ওই ওয়ার্ডের নিম্ন আয়ের সবাইকে স্লিপের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য দেয়া হচ্ছে। তার পরও হারিয়ে যাওয়া তালিকা খুঁজে বের করে সুন্দরভাবে যাতে বিতরণ করা যায় সে বিষয়ে চেষ্টা চলছে।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. ফকরুল ইসলাম বলেন, ‘নড়াইল পৌরসভাসহ বিভিন্ন স্থানে কিছু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। পণ্য বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করব।’