মাঠপর্যায়ে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে পুলিশ বাহিনী। গত দেড় দশকে এ বাহিনীতে বিপুলসংখ্যক নতুন পদ সৃজন ও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বাংলাদেশ পুলিশে মোট ৮৩ হাজার ৭০টি নতুন পদ সৃজন করা হয়। কিন্তু এ দেড় দশকে শুধু কনস্টেবল, এসআই ও পুলিশ সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেয়া হয় ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জনকে, যা মোট পুলিশ সদস্যের প্রায় অর্ধেক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের এ নিয়োগের বড় অংশই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে মূলত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ক্ষমতাসীনদের একটি বড় সমস্যা হলো তারা ক্ষমতা ছাড়তে চান না; ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চান। গত দেড় দশকে এ ক্ষমতা চিরস্থায়ী এবং অর্থ লোপাট করতে গিয়ে পুলিশসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি ইনস্টিটিউশনকে দলীয়করণ করা হয়েছে। পুলিশের এ বড় নিয়োগের পেছনেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মুখ্য ছিল এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার একটি হাতিয়ার হিসেবে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে তারা জনগণের আস্থা হারিয়েছে।’
জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে গত দেড় দশকে পুলিশ বাহিনীর পরিবর্তন নিয়ে গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে পুলিশের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৫ হাজার ৯২৫ জন কনস্টেবল, ১১ হাজার ৫১০ জন এসআই ও ২ হাজার ৪৮৪ জন পুলিশ সার্জেন্টকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। তাদের মধ্যে এসআই ও সার্জেন্ট পদে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে। এ মেয়াদে এসআই পদে ৪ হাজার ৯০৮ জন এবং সার্জেন্ট পদে ৭২৭ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া ২০০৯-২০১৩ সময়কালে এসআই পদে ৩ হাজার ৭৫১ ও সার্জেন্ট পদে ৪২৬ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৪-২০১৮ সময়কালে এসআই পদে ২ হাজার ৮৪৫ ও সার্জেন্ট পদে ৪২৬ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়।
এ দেড় দশকে দেশে ৬৪টি নতুন থানা, ৯৭টি তথ্যকেন্দ্র ও একটি ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। এছাড়া দেড় দশকে পুলিশের জন্য মোট ২ হাজার ৭৬০টি পিকআপ, ৫২৪টি জিপ, ৩৫৪টি ট্রাক, ১৩টি এপিসি, ১৭৮টি জলযান এবং ৭ হাজার ৬৩৪টি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্রও আধুনিকায়ন হয়েছে।
বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল থেকেও একাধিকবার উদ্বেগ জানানো হয়েছে। তবে সর্বশেষ কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্বিচারে গুলির ঘটনা জনরোষ তৈরি করে। এর ধারাবাহিকতায় গণ-অভ্যুত্থানে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশের বিভিন্ন থানায় পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক পুলিশ সদস্যের মৃত্যুও ঘটেছে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট একদিনে সারা দেশে ৪৫০টিরও বেশি থানা আক্রান্ত হয়েছে। এর আগে ৪ আগস্টেই মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জন পুলিশ সদস্যের। আহত হয়েছিল তিন শতাধিক। এসব ঘটনার জেরে পুলিশকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ রেখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়াসহ ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে যান নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তারা। ফলে দেশের সব থানাসহ ট্রাফিক পয়েন্টগুলো কার্যত ফাঁকা হয়ে যায়।
ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা আরো আগেই চলে গিয়েছিল। দেখা যেত মানুষ তখনই পুলিশের কাছে যেত, যখন তার আর উপায় থাকত না। কিন্তু তখনো দেখা যেত যে ভুক্তভোগী পুলিশের সহায়তা পাচ্ছে না, বরং অপরাধীকেই পুলিশ রক্ষা করছে। ফলে মানুষ পুলিশের ওপর আরো আগেই আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। গত কয়েক দিনে আমরা পুলিশের প্রতি জনগণের যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখালাম, তা একসময় ঘটতই। ছাত্র-জনতার আন্দোলন থামাতে পুলিশ যেভাবে দলীয় নির্দেশে কাজ করেছে, গুলি চালিয়েছে, তার জেরে এটা আমরা এখন দেখতে পেয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘তবে পুলিশ হত্যা বা থানায় ছাত্ররা আগুন দিয়েছে বলে মনে করি না। কারণ তারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিচার চেয়েছিল। এ সহিংসতা হয়তো কোনো সুযোগসন্ধানী মহল করেছে। তবে আমাদের দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে কাজে ফেরাতে হবে। যে ছাত্ররা কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে আন্দোলন করছে, তারা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে, বাকিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব পুলিশই অপরাধী নয়, যারা হুকুম পালন করেছে এবং যারা হুকুম দিয়েছে তাদের উভয়েরই বিচার করতে হবে। আর পুলিশসহ সব ইনস্টিটিউটে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, যেন ইনস্টিটিউটগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে জনকল্যাণে কাজ করে। এ পরিবর্তন একদিনে আসবে না। এজন্য ধৈর্য ধরতে হবে।’
দেশজুড়ে পুলিশের ওপর হামলার জেরে ৬ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি ঘোষণা দেন পুলিশ সদস্যরা। দেশের সব থানাসহ ট্রাফিক পয়েন্টগুলো কার্যত ফাঁকা হয়ে যায়। ফলে নিরাপত্তা ক্ষেত্রে একটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে। ৭ আগস্ট পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এ সময় পুলিশের অনেকেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সেনাবাহিনী ও বিজিবির সহায়তায় গতকাল দেশের বিভিন্ন থানার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ সংকট নিরসনে পুলিশকেই সামনে এগিয়ে আসতে হবে এবং সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে জনগণের আস্থা অর্জনে। পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরার বিষয়ে সাবেক আইজিপি মুহম্মদ নূরুল হুদা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশকে পুনর্গঠন করতে হবে, তবে পুনর্গঠন সহজ বিষয় নয়। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং ব্যাপক আলোচনার বিষয়। আপাতত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশকে সামনে আসতে হবে। জনসম্মুখে আসতে হবে। তাদের কাজে ফিরতে হবে।’
পুলিশের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পুলিশ যা করেছে, তা নিঃসন্দেহে অমার্জনীয়। সেটার জন্য যারা সবচেয়ে দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে অনুসন্ধানের আগেই জনগণ যদি পুলিশকে মেরে ফেলে, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দেড় দশকে এত পুলিশ অবশ্যই রাজনৈতিক কারণেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রোববার মন্ত্রণালয়ে যাব, সেখানে পুলিশ নিয়ে কথা হবে। পুলিশকে কীভাবে রাজনীতিমুক্তভাবে পরিচালিত করা যায়, নিয়োগপ্রক্রিয়াকে কীভাবে আরো স্বচ্ছ করা যায়, যেসব পুলিশ মারা গেছে, তাদেরকে ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেয়া যায়, এসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না কতদিন থাকতে পারব। তবে যতদিন থাকব, পুলিশে সংস্কারে কাজ করে যাব। পুলিশে কীভাবে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে কাজ করব। আমি চাই, পুলিশকে এমনভাবে সংস্কার করতে, যেন পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে না পারে। এ ধরনের কিছু মেকানিজম আমরা তৈরির চেষ্টা করব। পুলিশকে কতখানি জনবান্ধব করা যায়, পুলিশের ভেতর দুর্নীতি কতখানি কমানো যায়, সে বিষয়ে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। প্রয়োজনে দেশ-বিদেশের পুলিশিং ব্যবস্থা দেখব। তবে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, পুলিশ কিন্তু মানব প্রজাতিরই অংশ। তারা প্রযুক্তি নয় যে, কোথায় সমস্যা আছে, তা নির্ধারণ করে একদিনেই সমাধান করে ফেলা যাবে। এটা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’