রোলেক্স থেকে গুচি সবকিছুই লুট হয়েছে ওবায়দুল কাদেরের

‘পদ্মা ব্রিজ প্রজেক্ট ১০-১২-০১৭’—এই ক্যাপশনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ‘পদ্মা-১০’ নম্বর ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গাছে থাকা একটি ফুল ধরে ছবিটি তুলেছিলেন। বাম হাতের কব্জিতে তখন শোভা পাচ্ছিল ‘ইউলিসি নারদিন’ ব্র্যান্ডের একটি ঘড়ি, যার দাম ২২ হাজার ৭৯৯ ইউরো। বাংলাদেশী টাকায় ৩০ লাখেরও বেশি।

‘পদ্মা ব্রিজ প্রজেক্ট ১০-১২-০১৭’—এই ক্যাপশনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ‘পদ্মা-১০’ নম্বর ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গাছে থাকা একটি ফুল ধরে ছবিটি তুলেছিলেন। বাম হাতের কব্জিতে তখন শোভা পাচ্ছিল ‘ইউলিসি নারদিন’ ব্র্যান্ডের একটি ঘড়ি, যার দাম ২২ হাজার ৭৯৯ ইউরো। বাংলাদেশী টাকায় ৩০ লাখেরও বেশি। 

ফ্যাশন সচেতন ওবায়দুল কাদের ব্যবহার করতেন অভিজাত সব পণ্য। দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ির প্রতি ছিল তার বিশেষ দুর্বলতা। রোলেক্স ব্র্যান্ডের ডেটজাস্ট ও সেলিনি এবং দুষ্প্রাপ্য লুই ভিটন ট্যাম্বু স্পিন টাইম রিগাতা ঘড়িও ছিল আওয়ামী লীগের এ নেতার সংগ্রহে। আর সানগ্লাসের মধ্যে রে-ব্যান, বস, পোলার্ড এবং সিঙ্গাপুরের অক্টো ব্র্যান্ডের বেশকিছু চশমাও সংগ্রহে রেখেছিলেন। স্যুট বেশি পরতেন জিওভানি, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার ও গুচি ব্র্যান্ডের। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড গুচির বেশকিছু জুতাও তিনি ব্যবহার করতেন। পাঞ্জাবি ও কটির ওপরও তার ছিল বিশেষ আকর্ষণ। বিলাসী এসব পণ্য ওবায়দুল কাদের সংগ্রহ করতেন দেশের বাইরে থেকে। নিজের বাসভবনে ছিল কিছু দুর্লভ চিত্রকর্ম ও শোপিসও। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় ওবায়দুল কাদেরকে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হতো চিকিৎসার জন্য। তাই প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রাও বাসায় রাখতেন। 

ওয়ান-ইলেভেনের সময় গ্রেফতার হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যে বাসায় বন্দি ছিলেন ক্ষমতায় আসার পর সেটিকেই সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করতেন ওবায়দুল কাদের। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ওইদিন বিকালেই গণভবন ও সংসদ ভবনে প্রবেশ করে মানুষের ঢল। লুট হয় গণভবন ও সংসদ ভবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এ সময় সংসদ এলাকায় থাকা ওবায়দুল কাদেরের বাসভবনও আক্রান্ত হয়। লুট হয়ে যায় তার সব ফ্যাশন পণ্য, নগদ অর্থকড়ি, আসবাবপত্র, মূল্যবান চিত্রকর্ম, ব্যবহার্য নানা উপকরণ। তবে কী পরিমাণ জিনিস তার বাসা থেকে খোয়া গেছে সেটার প্রকৃত হিসাব এখনো অজানা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওবায়দুল কাদেরের এক ব্যক্তিগত সহকারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্যারের ঘড়ির বিষয়টি সবার জানা। উনি অভিজাত ব্র্যান্ডের সানগ্লাস, স্যুট ও জুতা ব্যবহার করতেন। যেমন রে-ব্যান, বস, পোলার্ড বা সিঙ্গাপুরের অক্টো ব্র্যান্ডের সানগ্লাস ছিল তার বেশি প্রিয়। আর স্যুটের মধ্যে ব্যবহার করতেন জিওভানি, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, গুচি ব্র্যান্ড। গুচির বেশকিছু জুতাও তিনি ব্যবহার করেছেন।’

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের একদিন আগেই গা ঢাকা দেন ওবায়দুল কাদের। পালাবদলের আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট দলের পক্ষ থেকে যে সংবাদ সম্মেলন করা হয় সেখানে তাকে দেখা যায়নি। ওবায়দুল কাদেরকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ৩ আগস্ট, দলের সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে। আলোচনায় আছে, তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত ২৭ আগস্ট ওবায়দুল কাদেরের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। 

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক নেতা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টাকা-পয়সা বা গাড়ি-বাড়ির চেয়ে ওবায়দুল কাদেরের পোশাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জার বিষয়ে গভীর অনুরাগ ছিল। ঘড়ি ও স্যুটের প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি ছিল তার সংগ্রহে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে স্যুটও সংগ্রহ করতেন। ওবায়দুল কাদেরের এসব শখের বিষয়টি দলেও ছিল ওপেন সিক্রেট। এটা নিয়ে তিনি নিজেও কখনো লুকোচুরি করেননি। যারা ওবায়দুল কাদেরকে পছন্দ করতেন তাদের অনেকেই এসব জিনিস তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন।’

নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওবায়দুল কাদেরের দেয়া চারটি হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে অস্থাবর সম্পদ ছিল ২৪ লাখ ৪৮ হাজার ৯৫ টাকা। তার স্ত্রী অ্যাডভোকেট ইশরাতুন্নেছা কাদেরের অস্থাবর সম্পদ ছিল ৪৮ লাখ ৮১ হাজার ৫২২ টাকা। দেড় দশক পর ২০২৩ সালে ওবায়দুল কাদেরের অস্থাবর সম্পদ দাঁড়ায় ৩ কোটি ২২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯৮ টাকা এবং স্ত্রীর ১ কোটি ২৮ লাখ ৪২ হাজার ৪৬৪ টাকা। 

নবম সংসদ নির্বাচনে ওবায়দুল কাদেরের দেয়া হলফনামায় দেখা যায়, তার পেশা ছিল লেখক ও সাংবাদিকতা। লেখালেখি থেকে আয় হতো বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর আইনজীবী স্ত্রীর আয় ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় দেখানো হয়, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বার্ষিক আয় ৩৮ লাখ ৭ হাজার ৫০৮ টাকা। এর মধ্যে বাড়ি ভাড়া থেকে ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৯২৪ এবং শেয়ার, সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানত থেকে ৬ লাখ ৯৭ হাজার ২৮৪ টাকা। এমপি ও মন্ত্রী হিসেবে বেতন-ভাতা পেতেন ১২ লাখ ৬০ হাজার এবং বই লিখে আয় ৪ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ টাকা। তার ওপর নির্ভরশীল সদস্যদের আয় ১২ লাখ ২৩ হাজার ৫১২ টাকা।

আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ওবায়দুল কাদেরের ব্যবহৃত ঘড়ি নিয়ে ২০২০ সালে সুইডেনভিত্তিক একটি অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট প্রতিবেদন করে। এর পর তা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। ওই বছরের ১৪ জানুয়ারি সচিবালয়ে এক সাংবাদিক ওবায়দুল কাদেরকে বলেন, ‘আপনি একজন কেতাদুরস্ত মানুষ, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘড়ি ব্যবহার করেন। নির্বাচনের হলফনামায় দেয়া তথ্য ও বার্ষিক আয়ের সঙ্গে ব্যয়বহুল ঘড়িগুলোর ব্যবহার তো অসামঞ্জস্যপূর্ণ।’ ওবায়দুল কাদের ওই সাংবাদিককে থামিয়ে দিয়ে তখন বলেছিলেন, ‘আমার যত ঘড়ি আছে, একটাও আমার নিজের পয়সা দিয়ে কেনা না। “ফর গড সেক” বলছি, এগুলো আমার কেনা না। আমি পাই। হয়তো আমাকে অনেকে ভালোবাসে। অনেক কর্মী বিদেশে আছেন। তারা আসার সময় এগুলো নিয়ে আসেন। আমাকে তারা উপহার দেন। আমি কী করব?’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির এক নেতা বলেন, ‘পার্টির বিভিন্ন কাজে নিয়মিত কাদের ভাইয়ের বাসায় আমার যাতায়াত ছিল। তার বাসভবনের জিনিসপত্রের অধিকাংশই সরকারি সম্পত্তি। তবে ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত সংগ্রহের মধ্যে বেশকিছু শোপিস ও চিত্রকর্ম ছিল। ৫ তারিখের পর সেগুলোর কী অবস্থা সেটা আমি বলতে পারব না।’

আরও