ঈদের আগে দেশের জনপ্রিয় তিন ওটিটি প্লাটফর্মের টেলিভিশন সেবা বন্ধ রয়েছে গত দুদিন ধরে। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো বায়োস্কোপ, টফি ও বঙ্গ। ওটিটি অপারেটর, কনটেন্ট প্রোভাইডার এজেন্সি ও ব্রডকাস্ট কনটেন্ট ডিস্ট্রিবিউটররা সেবা বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এর কারণ জানাতে পারেননি কেউই। এ বিষয়ে জানে না সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কিংবা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও।
ওটিটি অপারেটররা জানায়, গত মঙ্গলবার রাত থেকে লিনিয়ার টিভি সেবা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। এর কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে ডিস্ট্রিবিউটর ও কনটেন্ট প্রোভাইডার এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, ওটিটি অপারেটরদের তারা আর টিভি সেবা সরবরাহ করতে পারবে না। এর কারণ জানতে চাইলে সে বিষয়ে কোনো কিছু বলতে রাজি হয়নি তারা। এরপর কয়েকবার বিটিআরসিতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়েও যোগাযোগের চেষ্টা করে ওটিটি অপারেটররা। তবে কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি বলে তাদের অভিযোগ।
বাংলাদেশ সেলফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে এখনো ওটিটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। নীতিমালার খসড়া যখন প্রস্তুত হচ্ছে সে সময়ে সরকারের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তির স্বার্থ চরিতার্থ করতে ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্ম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের বাজারে যত টেলিভিশন বিক্রি হয় সবই ইন্টারনেটভিত্তিক। ডিশ ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা ও গ্রাহকদের সঙ্গে অসৎ আচরণের মাঝে এক প্রকার স্বস্তি এনে দিয়েছিল ওটিটি প্লাটফর্ম। গ্রাহক একটি ডিভাইসে যখন তাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছে তখনই ওটিটি প্লাটফর্ম বন্ধ করে দেয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আমরা মনে করি। ওটিটির গ্রাহকরা এ প্লাটফর্ম ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন প্রিমিয়াম প্যাকেজ কিনে থাকেন। অপারেটররা এরই মধ্যে গ্রাহকের কাছ থেকে এসব প্যাকেজ বাবদ অগ্রিম অর্থ আদায় করেছে। এখন গ্রাহক এসব প্লাটফর্ম দেখতে না পারায় আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
বিটিআরসির পক্ষ থেকে ওটিটি অপারেটরদের কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো ধরনের বিধিনিষেধ দেয়া হয়নি বলে সংস্থাটির এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বিটিআরসি ওটিটি প্লাটফর্ম বন্ধ করতে চাইলে শুধু টেলিভিশন সেবা নয়, সব ধরনের সেবা কার্যক্রমই বন্ধ করবে। শুধু টেলিভিশন সেবা আমরা বন্ধ করব না। এটা হয়তো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় করতে পারে।’
যদিও এ বিষয়ে কোনো লিখিত নির্দেশনা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়নি বলে জানান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার) মো. মজিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ওটিটি প্লাটফর্মে টেলিভিশনের সম্প্রচার অবৈধ। তারা এ ধরনের সেবা দিতে পারে না। এ ধরনের অবৈধ কোনো সম্প্রচার হলে সরকার যেকোনো সময় অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এর জন্য আমরা নীতিমালা তৈরি করছি। নীতিমালা হলে তারপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে এখনই এ বিষয়ে কোনো লিখিত নির্দেশনা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়নি।’
জানা যায়, দেশে কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক কার্যক্রম এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি পরিচালনার জন্য কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬, কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা ও লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০১০ রয়েছে। এছাড়া ব্রডকাস্টিং স্যাটেলাইট সার্ভিস ইন বাংলাদেশ গাইডলাইনের মাধ্যমে ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) সেবা প্রদান করা যায়। এসব আইন যখন হয় তখনো ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্লাটফর্মের ধারণা ছিল না। এ প্লাটফর্ম মূলত ২০১৫ সালের পর আসে। এরপর থেকে বৈশ্বিকভাবে ওটিটির ধারণা জনপ্রিয় হয়। দেশেও অনেক ওটিটি প্লাটফর্ম তৈরি হয়।
দেশে কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ওটিটি প্লাটফর্মগুলো। ২০২১ সালে ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়। তবে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও ওই খসড়া নীতিমালা আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে কোনো আইন, নীতিমালা বা গাইডলাইন ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করছে ওটিটি প্লাটফর্মগুলো।
এদিকে দেশী-বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলের অবৈধ সম্প্রচার বন্ধে গত মঙ্গলবার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রান্ত এক সভার আয়োজন করা হয় সচিবালয়ে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘সরকার অনুমোদিত দেশী ও বিদেশী টিভি চ্যানেলের ফিড শুধু বৈধ কেবল ও ডিটিএইচ অপারেটররা গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারবে। তাদের বাইরে অন্য কেউ এ কাজ করলে তা বেআইনি ও অবৈধ। এ বেআইনি কাজ বন্ধে সরকার আইনগত ব্যবস্থা নেবে। কেননা বেআইনি এ কাজের কারণে সরকার রাজস্ব হারায় এবং বিভিন্নভাবে বিদেশে অর্থ পাচার হয়। একই সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। যারা অবৈধ সেট টপ বক্সের মাধ্যমে অবৈধভাবে চ্যানেলগুলো দেখাচ্ছে, ক্লিনফিডের ব্যবস্থা না করে ইচ্ছামতো বিজ্ঞাপনসহ চ্যানেল দেখাচ্ছে, তাদের কারণে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসির মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিমন্ত্রী দেশী-বিদেশী টেলিভিশন বন্ধের কথা বললেও শুধু স্থানীয় ওটিটি প্লাটফর্মগুলোয় টিভি দেখানো বন্ধ হয়েছে। বিদেশী ওটিটি প্লাটফর্ম, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স বন্ধ হয়নি। ফলে দেশীয় বাজার ছোট হবে এবং সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে।
দেশের জনপ্রিয় ওটিটি প্লাটফর্ম বঙ্গর মালিকানায় রয়েছে বঙ্গবিডি। এছাড়া ওটিটি প্লাটফর্ম বায়োস্কোপের মালিকানা গ্রামীণফোন লিমিটেডের, রবি আজিয়াটা লিমিটেডের বিঞ্জ, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনের টফি। এসব প্লাটফর্মের বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা প্রায় তিন কোটি।
জানতে চাইলে বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন গাজী তাওহীদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলালিংকের ওটিটি প্লাটফর্ম টফিতে বিনোদন, খেলাধুলাসহ বাংলাদেশে লাইভ টিভি স্ট্রিমিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে কোনো ধরনের নোটিস এবং আলোচনা ছাড়াই মঙ্গলবার রাত থেকে টফি এবং অন্যান্য ওটিটি প্লাটফর্মের টিভি চ্যানেলের ফিড বন্ধ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত লাখো গ্রাহককে বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছে। আমরা খুবই দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি লাখো মানুষ যখন ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পথে মোবাইল ফোনে বসে টিভি উপভোগ করবে, তখনই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘শুধু স্থানীয় ওটিটি প্লাটফর্মগুলোর জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশী ওটিটি প্লাটফর্মগুলোর টেলিভিশন চ্যানেল খোলা রয়েছে। এতে স্থানীয় ওটিটিগুলোর দর্শক সংখ্যায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং এ নেতিবাচক প্রভাব সরকারের রাজস্ব আয়েও পড়বে। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবার সুবিধার জন্য সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি।’