মো. সেলিম তালুকদার। গত ১৮ জুলাই বাড্ডা-রামপুরা এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। ১৩ দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থেকে গত ১ আগস্ট মারা যান। গত বছর ৪ আগস্ট বিয়ে করেন সুমি আক্তারকে। সেলিম তালুকদারের মৃত্যুর তিনদিন পর কুলখানির আয়োজন করা হয়। সেদিনই ছিল তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী।
পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। তখনো জানতেন না তিনি বাবা হতে যাচ্ছেন। কুলখানি অনুষ্ঠানের দিন সেলিমের স্ত্রী অসুস্থ হন। ৫ আগস্ট চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে জানা যায়, সুমি আক্তার চার সপ্তাহ ছয়দিনের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচদিনের মাথায় মা হওয়ার খবরে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন সুমি আক্তার।
শুধু সেলিম তালুকদারের মৃত্যু শোকই নয়, অনাগত এক শিশুর পিতৃহীনতা, সুমি আক্তার আর সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কর্মক্ষমতা হারানো বাবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেসন্তান হারানো, এমন আকস্মিক বিপদে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই যেন জীবন্মৃত।
দুই বছর হয় বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পড়াশোনা শেষ করে সেলিম হাল ধরেন পরিবারের। কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে সহকারী মার্চেন্ডাইজার হিসেবে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেসন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা। অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূর ভবিষ্যৎ, পরিবারে একমাত্র আয়ের উৎস সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব হাতে ঢাকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেলিমের পরিবার।
সেলিম তালুকদারের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে। তিন বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা ঢাকার মধ্যবাড্ডা এলাকায়। বন্ধু-বান্ধব, এলাকাবাসীর কাছে তিনি ‘রমজান (ডাকনাম) নামে পরিচিত। বাবা সুলতান তালুকদার কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেক বছর আগে। পেশা হিসেবে নিজের রেন্ট-এ-কারে একসময় যাত্রী পরিবহন করতেন। ৬৬ বছর বয়সে গাড়ি চালানোর কাজে দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হাত-পা ফুলে যায় তার। কর্মে ফেরাও এখন অসম্ভব। এ পরিবারে হাল ধরার মতো নেই আর কেউ। কীভাবে সংসার চলবে, সেলিমের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে যেনে এক অনিশ্চিত জীবন পার করছে সেলিমের পরিবার।
জানা গেছে, কর্মজীবনে ব্যস্ততার কারণে শুরুর দিকে আন্দোলনে অংশ না নিলেও শিক্ষার্থীদের ডাকা শাটডাউন কর্মসূচি থেকে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নেন। পরিবার ও বন্ধুদের তথ্যমতে, ১৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে তিনি ফেসবুকে একের পর এক সহিংসতার ভিডিও প্রকাশ করতে থাকেন।
সেলিমের বোন জামাই মেহেদী হাসান হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮ জুলাই খুব সকালে সেলিম তার ইউনিভার্সিটির পুরনো আইডি কার্ডটি বের করেন। তার মা জিজ্ঞাসা করলে তেমন কিছু বলেননি। পরে মা বুঝতে পারেন তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন। তার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তাকে সেখানে যেতে নিষেধ করেন মা। উত্তরে সেলিম বলেন, ‘মানুষের ছেলেরা শহীদ হচ্ছে, তোমার ছেলে আঁচলে বাঁইধা রাখবা নাকি! দেখছো রংপুরের ছেলেটা ক্যামনে বুক আগাই দিয়া শহীদ হইছে, দোয়া করো যেন শহীদ হই।’”এ কথা শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা সেলিনা বেগম। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর অসুস্থতা ফেলেই চলে যান আন্দোলনে।
ওইদিন বেলা ১টার দিকে সেলিমের ফোন থেকে অপরিচিত একজন ফোন করে জানান, সেলিম গুলিবিদ্ধ এবং ফরাজি হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তার পর থেকে বন্ধ পাওয়া যায় ফোন। দিশেহারা মা ও তার ছোট বোন পাগলের মতো ছুটে যান হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে না পেয়ে ছুটে যান মুগদা মেডিকেলে। দেখতে পান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেলিম। ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে আছে তার শরীর ও মাথা। গুরুতর অবস্থায় আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় তাকে। অবস্থার আরো অবনতি হলে ধানমন্ডি পপুলার হসপিটালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ১৩ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ১ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। এদিন বাড্ডার লিংক রোডে কুমিল্লাপাড়া এলাকায় (ভাড়া বাসা) প্রথম জানাজা শেষে রাতেই গ্রামের বাড়ি নলছিটি উপজেলার উদ্দেশে রওনা হয় তার পরিবার। ২ আগস্ট সকালে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নিজ বাড়ির মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন সেলিম তালুকদার।