নড়াইলের লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার মধুমতি-নবগঙ্গা নদী ভাঙনকবলিত চরাঞ্চলের চাষীদের বাদাম চাষে ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাদাম চাষ। স্বল্প খরচে ভালো ফলন ও অধিক লাভ হওয়ায় চরাঞ্চলের কৃষক বাদাম চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এ চীনাবাদাম চাষ কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নদীভাঙনে নিঃস্ব প্রান্তিক চাষীরা বাদাম চাষে লাভবান হয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনছেন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন জেগে ওঠা চরের মাটিতে ধান, পাট, গম, সরিষাসহ অন্য ফসল হয় না। চরে বালিযুক্ত মাটিতে চীনাবাদাম চাষ ভালো হয়। পর পর তিন বছর জমিতে বাদাম চাষ করলে মাটির গুণাগুণ ফিরে আসে। তিন বছর বাদাম চাষ করার পর সে জমিতে ধান, পাট, গম, সরিষাসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদের উপযোগী হয়। জেলায় এ বছর ৩৫০ হেক্টর জমিতে চীনাবাদাম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৩৯৩ হেক্টরে আবাদ হয়েছে। নড়াইলের তিনটি উপজেলার মধ্যে লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলায় বাদামের আবাদ হয়। জেলায় চলতি বছর ৭৪৪ টন বাদাম উৎপাদন হয়েছে ।
কৃষকরা জানান, সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বাদাম আবাদ শুরু হয়। মে-জুনে জমি থেকে বাদাম তোলা হয়। লোহাগড়া উপজেলার শালনগর ইউনিয়নের মণ্ডলবাগ গ্রামের কৃষক বাবু মিয়া বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আমার বাবার রেখে যাওয়া প্রায় ১০ একর জমি মধুমতির গর্ভে চলে গেছে। জমিজমা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। বছর দুই হলো কিছু জমিতে চর জেগেছে। চরের জমিতে বাদাম ছাড়া অন্য ফসল হয় না। দুই বছর ধরে বাদাম চাষ করছি। গত বছরও ভালো ফলন হয়েছিল। চলতি বছরেও বাদামের ভালো ফলন হয়েছে।’
একই গ্রামের কৃষক ভুলু মিয়া বলেন, ‘কৃষিজমি সবটুকু নদীতে চলে (ভেঙে) যাওয়ার পর হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তখন অনেক কষ্টে সংসার চলেছে। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বাদাম চাষ করে ভালো আছি। এ বছর এক একর জমিতে বাদাম চাষ করেছি। খরচ বাদে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে।’
কৃষক তজিবর শেখ বলেন, ‘অন্যান্য ফসলের তুলনায় বাদাম চাষে খরচ কম, লাভ বেশি। বাদাম চাষ নদীভাঙন এলাকার কৃষকের জন্য আল্লাহর নিয়ামত।’
ধানাইড় গ্রামের কৃষক জুয়েল মৃধা বলেন, ‘নতুন চর জাগা জমিতে তিন থেকে চার বছর বাদামের আবাদ ভালো হয়। পরে সে জমিতে বাদামের আবাদ তেমন ভালো হয় না। তবে তিন-চার বছর বাদাম চাষ করা হলে সে জমিতে অন্য ফসল ভালো হয়।’ আড়িয়ালা গ্রামের কৃষক আলমগীর বলেন, ‘২০ বছরেরও বেশি সময় বাদাম আবাদ করি। চলতি বছর প্রায় তিন একর জমিতে ৭০-৭২ মণ পেয়েছি। এ বছর ৩ লাখ টাকার বেশি লাভ হবে বলে আশা করছি।’
বাদাম ব্যবসায়ীরা জানান, নড়াইল জেলার বাদাম অনেক বেশি সুস্বাদু। এ বাদামের সুনাম ও চাহিদা রয়েছে বেশ কয়েকটি জেলায়। বর্তমানে এক মণ বাদাম ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ী লিটন শেখ জানান, প্রতি বছর তিনি নড়াইল থেকে বাদাম কিনে সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিক্রি করেন। লাভও ভালো হয়।
বাদাম চাষ প্রসঙ্গে উপসহকারী কৃষি কর্মকতা সিকদার ইমরানুর রহমান বলেন, ‘জেলায় সাধরণত বারি-৮, বারি-৯ ও চিনা বারি-৪ জাতের চীনাবাদাম বেশি চাষ হয়। নদীতীরবর্তী এলাকা বাদাম চাষের উপযোগী। বেলে এবং বেলে ও দো-আঁশ মাটিতে বাদাম চাষ হয়। আমরা সবসময় কৃষকের পাশে থেকে তাদের এ চাষে সহযোগিতা করি। অন্য ফসলের তুলনায় বাদাম চাষে বেশি লাভ হয়।’
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, ‘চলতি বছর ৯০০ বাদাম চাষীর মাঝে বিনামূল্যে বীজ বিতরণ করা হয়েছে। মধুমতি ও নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ চর এলাকায় বাদাম চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সবসময় কৃষককে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাদাম চাষ বাড়ছে। চরাঞ্চলের জনপদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাদাম চাষ ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারগুলো বাদাম চাষের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।’