দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেশ ভালো বেতন-ভাতা দেয়। যদিও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই বেতন কাঠামো খুব নিম্নমানের। প্রভাষক থেকে অধ্যাপক—মাসে ১০-২০ হাজার টাকা বেতন দেয়, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাই শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দিতে যাচ্ছে সরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় প্রণয়ন করা হয়েছে প্রথম সংবিধি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি গত ফেব্রুয়ারিতে সংবিধির খসড়াটি জমা দিয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ সংশোধনের জন্য গত বছর একটি কমিটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আইন সংশোধনের পাশাপাশি ওই কমিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংবিধিও প্রণয়ন করে। সংশোধনসংক্রান্ত কমিটির সদস্য ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ। সংবিধি বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করতে গিয়ে দেখা গেল, ২০১০ সালে আইন প্রণয়নের পর কোনো সংবিধি করা হয়নি। তাই সংশোধন বিলের খসড়ার সঙ্গে একটি সংবিধিও প্রণয়ন করা হয়েছে।’ আইনে বিভিন্ন কমিটির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোন উপায়ে কাদের নিয়ে সেগুলো গঠন করা হবে, সে বিষয়ে তথ্য নেই। সংবিধিতে আইনের এমন নানা নির্দেশনার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।
জানা যায়, প্রস্তাবিত সংবিধিতে ৩৪টি বিধি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যূনতম বেতন-ভাতা জাতীয় বেতন কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এছাড়া শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য তহবিল গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ৩১ নম্বর বিধিতে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পূর্ণকালীন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য একটি সাধারণ ভবিষ্য তহবিল করবে এবং কর্মচারীরা সেই তহবিলে চাঁদা দেবেন। পাশাপাশি শিক্ষক ও কর্মচারীদের কল্যাণে প্রচলিত বিধি-বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যৌথ বীমা তহবিল, কল্যাণ তহবিল গঠন করবে বিশ্ববিদ্যালয়।
সংবিধির ৩২ নম্বর বিধিতে আলোচনা করা হয়েছে অবসর ভাতা নিয়ে। উপবিধি-১-এ বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পূর্ণকালীন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী অবসর বা স্বেচ্ছায় অবসর নিলে, পদত্যাগ করলে কিংবা পদ অবলুপ্তির কারণে চাকরি হারালে নির্ধারিত হার অনুযায়ী অবসর ভাতা ও আনুতোষিক দিতে হবে। আর মৃত্যু হলে অবসর ভাতা ও আনুতোষিক দিতে হবে তার পরিবারকে। উপবিধি-২-এ বলা হয়েছে, কমিশনের সুপারিশক্রমে সময়ে সময়ে সরকারের জারীকৃত আদেশ অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবসর ভাতা ও আনুতোষিক দেবে।
শিক্ষকদের ধাপ ও পদোন্নতির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে ২৩ নম্বর বিধিতে। এ বিষয়ে সংবিধিতে বলা হয়েছে, কমিশন প্রণীত নীতিমালার আলোকে প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষকদের অভিন্ন ধাপ অনুসরণ ও পদোন্নতি দেবে। বিধি-২৪-এ বলা হয়েছে, কমিশন প্রণীত নীতিমালার আলোকে প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বা টিচিং লোড নির্ণয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। কোনো বিভাগ বা প্রোগ্রামে খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা তার মোট শিক্ষকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশেই কোনো চাকরিবিধি নেই। আবার যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে, সেগুলোর একটি বড় অংশ কর্মীবান্ধব নয়। এজন্য যখন-তখন চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া, প্রাপ্য সুবিধা ও ভাতা না দেয়া, অনিয়মিত ও আংশিক বেতন-ভাতা প্রদানসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর বিরুদ্ধে। ইউজিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় সময়ই এ ধরনের নানা অভিযোগ পান তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত ও চাকরিচ্যুত অনেক শিক্ষক তাদের বেতন-ভাতা ও পাওনাদি না পাওয়ায় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসেন। আবার কেউ কেউ এসে বলেন, কোনো ধরনের নোটিস না দিয়ে হঠাৎ করেই তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কমিশন এ সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নীতি গ্রহণ করছে। সে আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। যেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়, তাই ভিন্ন চাকরিবিধি থাকতে পারে। তবে আমরা চাচ্ছি ন্যূনতম একটা মানদণ্ড ঠিক করে দিতে, যাতে কেউ এর নিচে নামতে না পারে।’
এদিকে মন্ত্রণালয়ের সংবিধিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটি ও তার কাঠামো বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনুষদ, একাডেমিক, পাঠক্রম, পরীক্ষা, ইনস্টিটিউট, শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ, শৃঙ্খলা, কর্মচারী নিয়োগ, যৌন হয়রানি প্রতিকার কমিটি। এছাড়া রেজিস্ট্রার, পরিচালক, উপদেষ্টা, প্রক্টরসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা কার্যপরিধি ও ক্ষমতার বিষয়ে সংবিধিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।