দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত সংসদে দলের এমপিদের অনেকেই মনোনয়ন হারান। আবার কেউ কেউ প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেলেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন করে উত্থান ঘটে অনেকের। তাদের ঘিরে তৈরি হয় নেতাকর্মীদের নতুন এক শক্তিশালী বলয়। এর ধারাবাহিকতায় স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে দাপট কমতে থাকে দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী অনেকেরই।
আঞ্চলিক রাজনীতিতে হারানো অবস্থান ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এক সময়ের দাপুটে এ নেতাদের অনেকেই। দলের রাজনীতিতে সক্রিয় অবদান রাখার মাধ্যমে শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা করছেন তারা।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদেও দলটির সংসদ সদস্যদের মধ্যে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, সাইফুজ্জামান শিখর, আয়েন উদ্দিন প্রমুখ নেতা ছিলেন নিজ নিজ এলাকার স্থানীয় রাজনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের টিকিটে প্রার্থিতার সুযোগ পাননি তারা। দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের নির্বাচনী তৎপরতার কেন্দ্রে চলে আসেন নতুন প্রার্থীরা। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপ হারানো শুরু হয় মনোনয়ন না পাওয়া প্রভাবশালীদের অনেকের। আবার কোনো কোনো নেতা মনোনয়ন পেলেও জেলা পর্যায়ের রাজনীতিতে নতুন প্রার্থীর দাপুটে আবির্ভাবে প্রভাব হারিয়েছেন তারাও।
চট্টগ্রামের রাজনীতিতে অন্যতম ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ছিলেন সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। তবে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে তিনি পরাজিত হন। বর্তমানে স্থানীয় রাজনীতিতে আগের প্রভাব অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন সামশুল হক চৌধুরী।
এ বিষয়ে মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি এমপি হিসেবে নতুন। বর্তমানে দলকে আরো শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছি। আগে আমার এলাকায় দলের রাজনীতি অনেক ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। বর্তমানে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি।’
এ বিষয়ে চেষ্টা করেও সামশুল হক চৌধুরীর কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এক সময় ফেনীতে আওয়ামী রাজনীতির ‘অঘোষিত’ নিয়ন্ত্রক ছিলেন প্রয়াত জয়নাল হাজারী। পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনাপ্রবাহ ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি। জয়নাল হাজারীর পর ফেনীর রাজনীতিতে শক্তিশালী চরিত্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটে নিজাম হাজারীর। বর্তমানে জেলাটির রাজনীতিতে তার দাপটে অনেকটাই ভাগ বসিয়েছেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম।
১৯৯৬ সালে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নিজাম হাজারী এবং ২০১১ সালে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঠিক এক বছর পরই ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। পরে ফেনী-২ আসন থেকে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি।
জয়নাল হাজারী যখন ফেনীর রাজনীতিতে ক্ষমতার শীর্ষে ঠিক সে সময়ই ছাত্রনেতা হিসেবে রাজনীতিতে আসেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম কলেজের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দপ্তর সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করলে আলাউদ্দিন নাসিম প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এরপর ২০১২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
দীর্ঘদিন ফেনীর রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসেবে সদর আসনের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর নাম এককভাবে উচ্চারিত হয়ে আসছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ আসনে (ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া) সংসদ সদস্য হিসেবে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ফেনীর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি খায়রুল বাশার মজুমদার তপন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নাসিম ভাই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় ফেনীতে আওয়ামী লীগ আরো শক্তিশালী ও সুসংগঠিত হবে। এখানে এক সময় বিএনপির শক্ত অবস্থান ছিল, এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আগামীতে এটি আওয়ামী লীগের দুর্গে পরিণত হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ছাত্রলীগের মাধ্যমে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম রাজনীতিতে আসেন। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকে তিনি স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। উন্নয়ন ও অগ্রগতির মাধ্যমে কীভাবে তার নির্বাচনী এলাকা এগিয়ে নেয়া যায় সেদিকেই নজর দিচ্ছেন।’
ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম বলেন, ‘রাজনীতিতে ইদানীং ব্যক্তিপূজার চর্চা বেড়েছে। আমি সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিপূজা বাদ দিয়ে দলীয় আদর্শের চর্চা করতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি অনুরোধ করে যাচ্ছি। নেতৃত্ব দিতে হলে জনপ্রিয় হতে হবে। জনপ্রিয় হতে হলে মানুষের সঙ্গে মিশে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি জনগণের জন্য; শুধু নেতাদের জন্য নয়। রাজনীতিতে আর্থিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কারণে সব শ্রেণীর মানুষ নেতৃত্বে আসতে পারছে না। তাই রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে এনে সব শ্রেণীর মানুষের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আমি কাজ করে যাচ্ছি।’
মাগুরার রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হন তিনি। আসনটিতে তার পরিবর্তে দলীয় মনোনয়ন পান ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এবং পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়লে রাজনীতিতে টিকে থাকতে সক্রিয়তা বাড়িয়েছেন শিখর।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত, দলের বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলন বা কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন তিনি। সক্রিয়তা বাড়লেও স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে পারেননি। সাকিব আল হাসান নির্বাচিত হওয়ার পর স্থানীয় রাজনীতির একটা বড় অংশই নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন।
দ্বাদশ নির্বাচনের পর মাগুরার রাজনীতিতে সাকিবের প্রভাব প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রানা আমির ওসমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাকিব আল হাসানকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যখনই মনোনয়ন দিয়েছেন তখন থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে নির্বাচিত করার জন্য কাজ করেছেন। তিনি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। এখন জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় হচ্ছে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের কারণে সাকিব আল হাসানকে সারা পৃথিবী চেনে, এখন রাজনীতিবিদ হিসেবে চিনবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘স্থানীয় রাজনীতিতে কিছু বিভেদ তো থাকেই। এখানে সাবেক সংসদ সদস্য যিনি ছিলেন তিনিও যথেষ্ট জনপ্রিয়। ফলে কিছু মানুষের তো তার প্রতি আনুগত্য রয়েছে। তবে বর্তমান সংসদ সদস্য সবাইকে নিয়েই কাজ করার চেষ্টা করছেন। বিগত সময়ে সাবেক সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণেই সবকিছু ছিল। পরিবর্তনের কারণে সেখানে ব্যত্যয় ঘটবে এটাই তো স্বাভাবিক। সে রকমই হয়েছে।’
সাকিব আল হাসান বর্তমানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। আর সাইফুজ্জামান শিখরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিলেন রাজশাহী-৩ আসনের টানা দুইবারের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিনের রাজশাহী-৩ আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়াকে চমক হিসেবেই নিয়েছিলেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। সেবার দলের মনোনয়ন না পাওয়া সাবেক এমপি সংসদ সদস্য মেরাজ উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জেতেন তিনি। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন আয়েন উদ্দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের এ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পরে ওই সিদ্ধান্ত থেকেও পিছিয়ে আসেন তিনি। আসনটিতে আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে দ্বাদশ নির্বাচনে জয় পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আয়েন উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। আগামী নির্বাচন এখনো অনেক বাকি। আমার এলাকার জনগণ ও দল যদি আমাকে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে বলে, তাহলে নেব।’
এক সময়ের দাপুটে নেতাদের প্রভাব হারানো ও নতুন নেতার শক্তিশালী উত্থানকে রাজনীতির স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে নতুন বলয় বা শক্তি তৈরি হয়েছে এটা বলা যাবে না। স্থানীয় রাজনীতিতে নানা বিষয় থাকে। আর উত্থান-পতন রাজনীতির স্বাভাবিক বিষয়। এটা মোকাবেলা করে প্রাসঙ্গিক থাকাটাই মুখ্য বিষয়।’