বান্দরবানে অবৈধ পাহাড় কাটা বন্ধই হচ্ছে না। প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা, স্থানীয় প্রশাসনের সচেতনতামূলক প্রচারণা ও তদারকির পরও পরিবেশবিধ্বংসী এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ পাহাড় কাটা-সংক্রান্ত তথ্য দিলেও সংশ্লিষ্টরা দ্রুত ব্যবস্থা নেয় না। ফলে বান্দরবানে অসংখ্য বড় পাহাড় ক্রমেই হারাচ্ছে নিজস্ব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে নামহীন ছোট ছোট টিলা বা পাহাড়। পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, অভিযোগ পেলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। তবে জনবল সংকট ও যানবাহন না থাকায় বিলম্ব হয় বলেও জানান সংস্থাটির বান্দরবানের সহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন চৌধুরী।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছরে ৬৮টি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে ১৬টি ড্রাম চুল্লির ইটভাটা। ৩২টি ইটভাটার উচ্চ আদালতে রিট করা আছে। তবে ভাটার জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো, পাহাড় কাটা, কৃষিজমি খুঁড়ে মাটি নেয়াসহ পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন সব অবৈধ কাজ করা যাবে বলে রিটে উল্লেখ নেই।
জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহলের অভিযোগ, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এ বলা আছে পার্বত্য জেলা পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোথাও ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু সে নিয়ম মানা হচ্ছে না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বনাঞ্চল, খাল-ঝিরি-ছড়া, পাড়াঘেঁষা ও সড়কের পাশে অবৈধ ভাটাগুলোর অবস্থান। ভাটার মালিকেরা পাহাড় কেটে ও ফসলি জমি খুঁড়ে মাটি নিচ্ছে। ফলে অবৈধ ভাটা এলাকায় অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড় হারিয়ে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত নভেম্বর মাসে দুটি, ডিসেম্বর মাসে দুটি ও চলতি মাসে ১০টি অবৈধ ইটভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন। তিন ধাপে পরিচালিত মোবাইল কোর্ট ১৪টি অবৈধ ইটভাটাকে মোট ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এদিকে ব্যক্তি পর্যায়েও মৎস্য চাষ, ভবন নির্মাণসহ নানা কারণে অবৈধভাবে পাহাড় কাটার অভিযোগ বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, বান্দরবান পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ফজর আলীপাড়ায় রাতের বেলায় এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কাটছেন মো. হোসেন নামের এক ব্যক্তি। সদর উপজেলার টংকাবতী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের শফিকুর রহমান পাড়ায় এলজিইডির নাম ভাঙিয়ে মৎস্য হ্যাচারির জন্য নির্বিচারে পাহাড় কেটে কাঁচা সড়ক নির্মাণ করেছে শামসু মিয়া নামের আরেকজন। এছাড়া লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম উপজেলায়ও কয়েকটি স্থানে পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত সোমবার জেলা সদর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার শফিকুর রহমান পাড়ায় সরেজমিনে দেখা যায়, তিন দিকে নির্বিচারে পাহাড় কেটে জমির চারদিকে আনুমানিক এক কিলোমিটার কাঁচা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কাটার দাগও স্পষ্ট। স্থানীয়রা জানান, ইউপি সদস্য নুরুল কবিরের দেয়া এলজিইডির প্রকল্প জানিয়ে শামসু মিয়া তার মৎস্য হ্যাচারির জন্য পাহাড় কেটে বাঁধ দিয়েছেন। হ্যাচারির সুবিধার্থে সড়কও করেছেন। বর্ষাকালে বাঁধের বাড়তি পানি খালে ফেলার জন্য জমির পশ্চিম দিকে পাহাড় কেটে গভীর খাদের মতো করা হয়েছে। পাহাড় কাটার মাটি পড়ে হাঙ্গর খালের ওই অংশ সরু হয়ে গেছে। সরু অংশে পানি তোলার জন্য একটি পাম্প মেশিনে পাইপ সংযোগ করা রয়েছে।
এলজিইডিতে আবেদনের বিষয়ে জানতে গত দুই দিনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও কোনো সাড়া দেননি ইউনিয়নটির ৬ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার নুরুল কবির। এ বিষয়ে সেলফোনে কথা হলে মো. সামশু মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, মৎস্য হ্যাচারি, সড়ক করতে কোন অফিস থেকে অনুমতি নিতে হয় তা জানা নেই। এলজিইডির প্রকল্প নয়, নিজের টাকায় জনগণের জন্য সড়ক করে দিয়েছেন বলে দাবি তার।
এ বিষয়ে এলজিইডির বান্দরবান সদর উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আমানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেড় মাস আগে টংকাবতী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার নুরুল কবির নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর শফিকুর রহমানপাড়া ব্রিক সলিং সড়ক থেকে নুরার দোকান পর্যন্ত নতুন সড়কের জন্য আবেদন করেছিলেন। নির্বাহী প্রকৌশলী আবেদনটির বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এখনো দেখতে যাওয়া হয়নি।’
টংকাবতী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো প্রদীপ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাহাড় কাটার খবর পেয়ে গত ১৭ জানুয়ারি উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে ছবি ও ঠিকানাসহ অবগত করেছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বান্দরবানে আমিসহ তিনজন দায়িত্বপ্রাপ্ত। দাপ্তরিক যানবাহন নেই। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে ইটভাটা ও ব্যক্তি পর্যায়ে অবৈধ পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। টংকাবতীর মো. সামশু মিয়া ২০১৯ সালে মৎস্য হ্যাচারির জন্য অনুমোদন নিয়েছিলেন। ওই হ্যাচারির নামে সম্প্রতি অবৈধভাবে প্রায় এক লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে।’
ভাটার বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) উম্মে কুলসুম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইটভাটার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের নিয়মিত মোবাইল কোর্ট চলছে।’ পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।’