বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের রাবার বুলেটে চোখ হারাতে বসেছেন ইয়াসির আরাফাত। তিনি ডান চোখে দেখতে পেলেও বাঁ চোখে মোটেও দেখতে পাচ্ছেন না। শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন ১০০টি রাবার বুলেট। গত ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করেন তিনি।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠেন আরাফাত। কৃষক বাবা আজিজুল হকের দুই ছেলের মধ্যে বড় তিনি। মা গৃহিণী। টানাপড়েনের সংসারে কোনোমতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য ঘুরতে হয়েছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল। সঠিক সময়ে চিকিৎসাও পাননি আরাফাত। আলোহীন বাঁ চোখ নিয়েই হয়তো কাটাতে হবে বাকি জীবন।
ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘ভাগ্যে যা ছিল, তাই হয়েছে। নিজের ওপর কোনো আক্ষেপ নেই। এটা ভালো লাগছে যে দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি। আমার কোনো আফসোস নেই। তবে চোখে দেখতে না পারায় হয়তো নিজের কাছে একটু আনইজি লাগবে।’
গত ১৮ জুলাই বেলা ১১টা। উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন আরাফাত। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দুপুর ১২টায় ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। বেলা ১টার দিকে পুলিশ, র্যাব সাঁজোয়া যান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর যখন হামলা শুরু করে সেই হামলায় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন। দুই হাতে প্রায় ৫০টি রাবার বুলেট, মাথায় ২০টি, বুকে ২০টি, মুখ ও চোখে ১০টি রাবার বুলেট লাগে তার। বাঁ চোখের ভেতরে ৩টি রাবার বুলেটই নিভিয়ে দিয়েছে চোখের আলো।
আহত হওয়ার পর লোকজন ধরে নিয়ে ভর্তি করান ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বেলা ৩টায় নিয়ে যাওয়া হয় হাই কেয়ার হাসপাতালে। চোখের অবস্থা ভালো নয় জানিয়ে হাসপাতাল থেকে শুধু চোখের ড্রপ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে জাতীয় চক্ষু হাসপাতালে রেফার করা হয়। এ দুই হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কোনো চিকিৎসাই দেয়া হয়নি তার। চক্ষু হাসপাতালে গেলে বিকাল সাড়ে ৪টায় তাৎক্ষণিক অস্ত্রোপচার করে একটি বুলেট বের করা হয়। এরপর ২৩ জুলাই বাংলাদেশ আই হসপিটালে গেলে তারা বলেন, ‘চোখের অবস্থা খুব ভালো না। যত দ্রুত সম্ভব অস্ত্রোপচার করতে হবে।’ ২৭ জুলাই অস্ত্রোপচার করে আরো একটি রাবার বুলেট বের করা হয়। এখনো রয়ে গেছে একটি বুলেট। বাঁ চোখের ইনফেকশন যাতে অন্য চোখে ছড়িয়ে না পড়ে সে ব্যবস্থা নিয়েছেন চিকিৎসকরা। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আরো একটি অস্ত্রোপচার করার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এখনো যে একটি বুলেট চোখে রয়ে গেছে, সেটি অস্ত্রোপচারের সময় সম্ভব হলে বের করা হবে, অন্যথায় চোখেই থেকে যাবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে আরাফাতের। তবে পরবর্তী চোখের অস্ত্রোপচারসহ অন্যান্য চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে শঙ্কিত তিনি। শরীরের ১০০টি রাবার বুলেট কীভাবে বের করা হবে তা নিয়েও দুশ্চিন্তার শেষ নেই তার। আরাফাতের বাবা আজিজুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য কাজ করেছে। কোনো আফসোস নেই। অনেকে এ আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, ছেলে বেঁচে আছে। এটাই অনেক।’