দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবারের উপজেলা পরিষদ ভোটকেও প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি ও জামায়াত। ফলে এ নির্বাচনেও লড়াই হতে যাচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেই। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) কিংবা মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনদের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে হাইকমান্ড থেকে। এরই মধ্যে যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদেরকেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে কাদেরকে ‘স্বজন’ ধরা হবে, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি ক্ষমতাসীন দলটি। এ নিয়ে তাই বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় কিছু সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী তাদের স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকায় আত্মীয়-স্বজনকে প্রার্থী করছেন। এ কারণে দলের তৃণমূলে কমান্ড ভেঙে পড়েছে। এমপি-মন্ত্রীদের যেহেতু প্রশাসনের ওপর খবরদারির সুযোগ আছে; এ কারণে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, এমপি-মন্ত্রী পরিবারের সদস্যরা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের মাধ্যমে এরই মধ্যে দলীয় হাইকমান্ডের বার্তা তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের সমমনা দলগুলো ভোটে আসছে না। আবার আমাদের আদর্শিক জোট ১৪ দলেরও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো প্রার্থী নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলে সেটি সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচক বার্তা দেবে। আমরা চাই, যাতে ভোট সুষ্ঠু হয় এবং ভোটারের উপস্থিতিও যেন সম্মানজনক হয়। সে কারণেই এ কৌশল নেয়া হয়েছে। ভোট থেকে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
তৃণমূলের নেতারা অবশ্য বলছেন, উপজেলা নির্বাচন ঘিরে কেন্দ্র থেকে মৌখিক নির্দেশনা ও পরামর্শ জানানো হলেও এখনো লিখিত কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এমপি-মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনের সীমা কত দূর পর্যন্ত যাবে, এ বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়নি। এছাড়া অনেক মন্ত্রী ও এমপির আত্মীয় আছেন, যারা বর্তমানে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তারা পুনরায় ভোট করতে চাইলে তাদেরও সরে দাঁড়াতে হবে কিনা সেসব বিষয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে।
স্বজনের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল বলেন, ‘স্বজন বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে এটা আমি বলতে পারব না।’
এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে চার ধাপে। প্রথম ধাপে ১৫০ উপজেলায় ভোট ৮ মে। এ ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া সদর থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা, যিনি দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই। নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনের অংশ না নেয়ার বিষয়ে হাইকমান্ডের নির্দেশনা অমান্য করেই তিনি জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আতাউর রহমান আতা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের নির্দেশনা শুনেছি। তবে এ-সংক্রান্ত লিখিত কোনো নির্দেশনা পাইনি। স্বজন বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে সেটিও পরিষ্কার নয়। আমি রানিং উপজেলা চেয়ারম্যান, দলেও একটি দায়িত্বশীল জায়গায় রয়েছি। নির্বাচনে অংশ নেয়া যাবে না, এ নীতি আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।’
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়নি। সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আর আমি পরপর দু’বারের উপজেলা চেয়ারম্যান। আমার নির্বাচন করতে পার্টি থেকে কোনো বাধা আছে বলে মনে হয় না।’
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, এমপি-মন্ত্রীরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারাও বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দলের বার্তা একেবারে পরিষ্কার। এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এটা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত অমান্য করলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আইনে দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ভোট করার সুযোগ থাকলেও স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বা মনোনয়ন না দেয়ার কথা আগেই জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে দলটির নেতাদের নির্বাচন করতে হচ্ছে যার যার মতোই। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে যেন কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন সেজন্য তাদের স্বজনকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত দলীয়ভাবেই নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ। একই সঙ্গে স্বজন বলতে কারা হবে সে প্রসঙ্গও ব্যাখ্যা করে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বজনরা অংশ নিতে পারবে না সেটা ঠিক না। বিষয়টি হচ্ছে তাদের ডাইরেক্ট ফ্যামিলি—ছেলে-মেয়ে, ভাই এরা পারবে না। আবার কেউ সিটিং উপজেলা চেয়ারম্যান যদি কোনো এমপি বা মন্ত্রীর আত্মীয় হন তাকে কীভাবে বাদ দেব? বলা হয়েছে এমপি, মন্ত্রীর ক্লোজ রিলেটিভ অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে ভাই-বোন; ডেফিনিয়েশন কিন্তু আছে, ভালো করে বুঝতে হবে।’
এদিকে চার ধাপের উপজেলা নির্বাচনের সময় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সব রকম কমিটি গঠন ও সম্মেলন বন্ধ ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে জানান, উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন হচ্ছে। সামনে প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন চলাকালে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে কোনো সম্মেলন, মেয়াদোত্তীর্ণ সম্মেলন ও কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে।
মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। যারা প্রার্থী হতে চান, তাদেরও নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। যারা আছেন তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।’
নির্দেশনা দেয়া হলেও অনেকের এখনো নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রত্যাহারের তারিখ শেষ হোক, তার আগে এ বিষয়ে কীভাবে বলা যাবে?’