গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি বা নকল রোধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ। ‘দ্য রুলস ফর দ্য প্রিভেনশন অব প্ল্যাজারিজম’ শীর্ষক নীতিমালাটি অনুমোদনের জন্য আগামীকাল অনুষ্ঠিতব্য একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় উত্থাপন করা হবে। প্রস্তাবিত এ রুলস অনুযায়ী, গবেষণায় নকলের অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিকে শুরুতে জরিমানা সাপেক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে গবেষণায় নকলের মাত্রা অনুযায়ী চাকরিচ্যুতি, পদাবনতি ও ডিগ্রি বাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
নীতিমালায় প্ল্যাজারিজমের সংজ্ঞায়নের বিষয়ে বলা হয়েছে, উদ্ধৃতি বা স্বীকারোক্তি ছাড়া নিজের লেখায় অন্য কারো তথ্য-উপাত্ত, ধারণা, লেখা কিংবা কাজের ব্যবহার বা নকল করা। এক্ষেত্রে অন্যের লেখা বা কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বা তথ্যের মিলের মাত্রার ওপর প্ল্যাজারিজমের ধরন চিহ্নিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় সামঞ্জস্যের চারটি ধরন রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ পর্যন্ত তথ্যের সামঞ্জস্যকে রাখা হয়েছে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় (লেভেল জিরো)। তবে এক্ষেত্রে একই সূত্র থেকে কোনোভাবেই ২ শতাংশের বেশি তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের সামঞ্জস্য কোনো ধরনের শাস্তির আওতায় থাকবে না। তবে যদি একই সূত্র থেকে ২ শতাংশের বেশি তথ্য ব্যবহার করা হয় তাহলে সেটা সামঞ্জস্যের নিম্ন ধাপ বা লেভেল-১-এর আওতায় পড়বে।
নীতিমালায় ২০ শতাংশের ওপর থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সামঞ্জস্য লেভেল-১-এর অপরাধ। এর প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা ক্রেডিট ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে ওই সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এ সময়ে সংশোধন প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হলে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা সাপেক্ষে সংশোধনের জন্য আরো ছয় মাস দেয়া হতে পারে। তবে দ্বিতীয় ধাপেও ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্স বাতিল বা প্রত্যাহারের বিধান রাখা হয়েছে।
লেভের-১-এ দায়ী ব্যক্তি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা কিংবা গবেষক হন এবং তিনি যদি নকলকৃত ডিগ্রির ভিত্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতি বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন তাহলে সংশ্লিষ্ট সময়ে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ অনতিবিলম্বে কোষাগারে ফেরত নেয়া হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে ২০ হাজার টাকা জরিমানা সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিকে ছয় মাসের মধ্যে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ দেয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে প্ল্যাজারিজমমুক্ত প্রমাণ করতে পারলে ডিগ্রিটি নবায়ন করা হলেও অন্য কোনো সুবিধা সরবরাহ করা হবে না। সংশোধনে ব্যর্থ হলে দায়ী ব্যক্তি পূর্ববর্তী ধাপে পদাবনতি ও দুই বছরের জন্য পদোন্নতি বন্ধের শাস্তির মুখে পড়বেন।
গবেষণায় ৪০-এর ওপর থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সামঞ্জস্য মধ্য ধাপ বা লেভেল-২-এর আওতায় পড়বে। এক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তি আর্থিক জরিমানা সাপেক্ষে নকলকৃত পাণ্ডুলিপি সংশোধনের জন্য সর্বোচ্চ দেড় বছর পর্যন্ত সময় পাবেন। ওই সময় সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা ক্রেডিট স্থগিত থাকবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশোধনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্সটি বাতিল হয়ে যাবে। লেভেল-২-এ দায়ী ব্যক্তি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা কিংবা গবেষক হন এবং তিনি যদি নকলকৃত ডিগ্রির ভিত্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতি বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন তাহলে সংশ্লিষ্ট সময়ে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ অনতিবিলম্বে কোষাগারে ফেরত নেয়া হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি এক ধাপ পদাবনতি ও চার বছরের জন্য পদোন্নতি বন্ধের শাস্তির মুখে পড়বেন দায়ী ব্যক্তি।
৬১ শতাংশের ওপর সামঞ্জস্যকে উচ্চ ধাপ বা লেভেল-৩-এ রাখা হয়েছে। এ মাত্রার সামঞ্জস্যের প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্স দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হতে পারে। দায়ী ব্যক্তি ওই সময়ের মধ্যে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা সাপেক্ষে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের সুযোগ পাবেন। এতেও ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ডিগ্রিটি বাতিল ও কোর্স অনুত্তীর্ণ (এফ গ্রেড) হিসেবে গণ্য হবে। লেভেল-৩-এ দায়ী ব্যক্তি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা কিংবা গবেষক হন এবং তিনি যদি নকলকৃত ডিগ্রির ভিত্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতি বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন তাহলেও সংশ্লিষ্ট সময়ে পাওয়া অর্থ কোষাগারে ফেরত নেয়া হবে। একই সঙ্গে ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি এক ধাপ পদাবনতি ও ছয় বছরের জন্য পদোন্নতি বন্ধের শাস্তির মুখে পড়বেন তিনি। কোনো অভিযুক্ত লেভেল-৩ পর্যায়ের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে, তার চাকরিচ্যুতির বিধান রাখা হয়েছে। আবার সব পর্যায়ের প্ল্যাজারিজমের ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রত্যাহারের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি অভিযুক্তের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি বা কোর্সের সুপারভাইজার, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জার্নালের ক্ষেত্রে এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে নীতিমালায়।
প্ল্যাজারিজমের অভিযোগ গঠন ও তদন্ত প্রক্রিয়ার বিষয়ে প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান কিংবা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কাছে যেকোনো ব্যক্তিই লিখিতভাবে এ বিষয়ক অভিযোগ জমা দিতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে উপাচার্য সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন, তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। নীতিমালায় এসবের পাশাপাশি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি রোধে বিভিন্ন ধরনের ১১টি পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। গবেষণা কার্যক্রমে অন্যের উদ্ধৃতি ব্যবহার, প্ল্যাজারিজম ডিটেকশনের সফটওয়্যার ও টুলের ব্যবহারসহ অংশীজনদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা ও উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলা হয়েছে সেখানে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটির ২০২০ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘দ্য প্রিভেনশন অব প্ল্যাজারিজম রুলস’ প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। সে নির্দেশনার আলোকে নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বস্তুত অর্থে প্ল্যাজারিজমে অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া এ নীতিমালার মূল লক্ষ্য নয়। এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের প্ল্যাজারিজমের মতো একটি একাডেমিক অপরাধ ও এর রোধকরণ বিষয়ে সচেতন করে তোলা। এজন্য নীতিমালার নামকরণে “প্রিভেনশন”কে সামনে রাখা হয়েছে। নীতিমালার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউএসির (ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল) মাধ্যমে প্ল্যাজারিজম রোধে বিভিন্ন কর্মশালা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেয়া হবে; যাতে ডিগ্রি প্রদান ও কোনো ধরনের গবেষণা নিবন্ধ, বই কিংবা অন্য কোনো গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশের আগেই প্ল্যাজারিজম রোধ করা সম্ভব হয়। এর পরও যদি কেউ এ ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
ড. মাকসুদ কামাল আরো বলেন, ‘নীতিমালাটি একাডেমিক কাউন্সিলে উত্থাপন করা হবে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ বিষয়ে মতামত দেয়ার সুযোগ পাবেন। তাদের যৌক্তিক মতামতের আলোকে নীতিমালায় সংশোধনী আনার সুযোগ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন করা হবে।’