বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি মৌসুমে নোয়াখালীতে শীতকালীন সবজি আবাদ বেড়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আবাদ হয় ১০ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৮৩০ হেক্টরে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১১ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করেন কৃষি কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে ৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার ১৪ হাজার হেক্টরে আবাদ হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ইতিমধ্যে সুবর্ণচরে ৩ হাজার ৭০০, হাতিয়ায় ১ হাজার ২০, সদর উপজেলায় ৫৮০, বেগমগঞ্জে ৩০০, সেনবাগে ১৮০, চাটখিলে ৩০০, কোম্পানীগঞ্জে ৫৮০, সোনাইমুড়িতে ৯০ ও কবিরহাটে ২৫০ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক জানান, করলা, লাউ, টমেটো, বেগুন, মারপা, মরিচসহ বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদন হচ্ছে জেলার চরাঞ্চলে। এতে কৃষক পরিবারে সচ্ছলতার পাশাপাশি উন্নত হচ্ছে গ্রামীণ জীবনযাত্রা। তবে জৈবসার ও সনাতন নানা পদ্ধতির মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করলেও রোগবালাই নিয়ে শঙ্কিত কৃষক। বেসরকারি কোম্পানির বালাইনাশক ব্যবহারে বিপাকে পড়ছেন কৃষক।
কৃষক আহসান আলীর দাবি, সবজি উৎপাদন করে নিজেরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি অবদান রাখছেন কৃষি অর্থনীতিতে। কিন্তু সে তুলনায় সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন না তারা। ভালো পরামর্শ না পাওয়ায় নকল বালাইনাশক ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। ফলে ভবিষ্যতে ভালো উৎপাদন নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে তাদের মাঝে। নিয়মিত কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ পেলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের উৎপাদিত সবজি পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
সরজমিন দেখা গেছে, সুবর্ণচর উপজেলার উত্তর চরবাগগা ও চরজব্বার গ্রামের পাঁচ শতাধিক কৃষক সবজি আবাদ করছেন। করলা, টমেটো, বেগুন, শসা ও মরিচসহ শীতকালীন সবজি আবাদ করছেন তারা। আগাম এসব সবজি আবাদ করায় আর্থিক সচ্ছলতা ফিরেছে কৃষক পরিবারে।
কৃষক হাজি নূর নবী জানান, তিনি এ বছর দুই একর জমিতে সবজি উৎপাদন করেছেন। এর মধ্যে বেগুন, করলা ও মরিচ বেশি আবাদ করেছেন। এরই মধ্যে ৬ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। এ মৌসুমে সব মিলিয়ে অন্তত ১২ লাখ টাকার সবজি বিক্রির প্রত্যাশা করছেন তিনি।
সবজি উৎপাদন নিয়ে কিছু শঙ্কার কথা জানান নূর নবী। তার দাবি, এ বছর বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দিয়েছে সবজি খেতে। বালাইনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের।
কৃষি কর্মকর্তাদের না পেয়ে দোকানিদের পরামর্শে একই বালাইনাশক বারবার ব্যবহার করছেন তারা। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, চর জেগে ওঠার পর এসব গ্রামে রোপা আমন ছাড়া আর কিছুই চাষ হতো না। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলের কৃষক নিজ উদ্যোগে সবজি আবাদ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে একে অন্যকে দেখে সবজি আবাদ বাড়াতে শুরু করে। প্রথম দিকে যাতায়াত ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল। এ কারণে সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষক। তবে বর্তমানে সড়ক উন্নত হওয়ায় পাইকাররা সরাসরি সংগ্রহ করছে উৎপাদিত সবজি। এতে ভালো দাম পাওয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষক।
সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শীবব্রত ভৌমিক জানান, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে তারা সমন্বিত কৃষি ইউনিট গড়ে তুলছেন। তাদের সংস্থায় যে পরিমাণ লোকবল রয়েছে সেটা দিয়ে তারা পুরো উপজেলায় কাজ করছেন। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারে কৃষককে উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিয়েও সহায়তা করছেন তারা। বাজার ব্যবস্থা উন্নয়ন করার পাশাপাশি কৃষকের বেশি বেশি প্রশিক্ষিত করা গেলে নিরাপদ সবজি উপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন তিনি।
শীবব্রত ভৌমিক বলেন, ‘সম্প্রতি নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে মালসিং পদ্ধতিতে সবজি আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক মালসিং পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে আগাছা থেকে মুক্ত হচ্ছে এবং নির্বিঘ্নে গাছ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক নিজেরাই এখন মালসিং পদ্ধতি তৈরি করছেন। আগে কৃষকের পিকেএসএফ সহায়তা করলেও এখন নিজেরই এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।’
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শহিদুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে সবজি আবাদ বাড়ার কারণে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে। কৃষক যেমন উন্নত জীবনযাপন করছেন, একই সঙ্গে পুরো জেলার অর্থনীতি উন্নত হচ্ছে। লোকবল সংকটের কারণে কৃষককে দ্রুত সেবা দেয়ায় কিছুটা সমস্যা হয়। তবে কৃষক সহযোগিতা চাইলে যেকোনো ইউনিটের কর্মকর্তা সহায়তা করবেন। বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষককে আরো বেশি সচেতন করা হবে। একই সঙ্গে বালাইনাশক বিক্রেতাদেরও সতর্ক করার ওপর জোর দেয়া হবে।’