পার্বত্য চট্টগ্রামে পানির উৎস ধ্বংস করছে সেগুন!

দেশের এক-দশমাংশ অঞ্চল নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রকৃতিগতভাবে তিন পার্বত্য জেলার প্রান্তিক মানুষের সুপেয় পানির জোগান দেয় পাহাড়ের ঝিরি-ঝরনাগুলো।

দেশের এক-দশমাংশ অঞ্চল নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। প্রকৃতিগতভাবে তিন পার্বত্য জেলার প্রান্তিক মানুষের সুপেয় পানির জোগান দেয় পাহাড়ের ঝিরি-ঝরনাগুলো। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, দুর্গম এলাকার ঝিরি-ঝরনাগুলোয় বছরজুড়ে পানি পাওয়া যায় না। এতে করে পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষ সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির সংকটে ভুগছে। ঝিরি-ঝরনা ও পানির উৎস নষ্ট হওয়ার পেছনে পার্বত্য চট্টগ্রামে এককভাবে সেগুনবাগান সৃজনকে দায়ী করছেন পরিবেশকর্মী ও বন কর্মকর্তারা। যদিও একসময় পাহাড়ে সেগুনবাগান সৃজন করিয়েছিল বন বিভাগই। 

পরিবেশবাদী ও বিশিষ্টজনরা বলছেন, অথনৈতিকভাবে সচ্ছল হওয়ার আশায় পাহাড়ের মানুষ দীর্ঘদিন সেগুনবাগান সৃজন করে আসছে। কিন্তু এতে করে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর ক্রমাগত বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাহাড়ে বনজ বৃক্ষ বা পানি সংরক্ষণে উপযোগী বৃক্ষ সৃজন না করে সেগুনের বিস্তার বাড়ায় দিন দিন শুষ্ক হয়েছে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশ। প্রাকৃতিক ঝিরি-ঝরনাগুলোয় পানির সংকটে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। রাঙ্গামাটির সাজেক, জুরাছড়ির দুমদুম্যা, বরকল, বিলাইছড়িসহ বান্দরবান-খাগড়াছড়ির বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকায় পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেবল নিরুৎসাহিতকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সেগুনবাগানের বিস্তার ঠেকাতে বন বিভাগকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। 

রাঙ্গামাটিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পরিবেশবিরোধী বৃক্ষ সৃজনের ফলে পাহাড়ের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু আমাদের ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে খাল-বিল ঝিরি-ঝরনার পানি ব্যবহার করা প্রয়োজন। পাহাড়ে পানির উৎস কমে যাওয়া নিয়ে আমাদের একটা সমীক্ষা চলছে।’ 

সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ২৬ উপজেলায়ই সেগুনবাগান রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই পাহাড়ে সেগুনবাগান সৃজন হয়ে আসছে। ব্রিটিশ শাসনামলে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ডানিডা ও স্বাধীনতার পর বন বিভাগের উদ্যোগে এ অঞ্চলে সেগুনের আধিপত্য বাড়ে। তবে পাহাড়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে এ উদ্যোগ থেকে সরে এসে বন বিভাগ এখন সেগুনবাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছে। বর্তমানে পাহাড়ে বন বিভাগের সেগুনবাগানের চেয়েও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা বেশি। বন বিভাগের অধীনে ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পর্যায়ে পাহাড়ে কত পরিমাণ ভূমিতে সেগুনবাগান রয়েছে—এ-সংক্রান্ত তথ্য কোনো দপ্তর ও বন কর্মকর্তাদের কাছে পাওয়া যায়নি। 

সেগুন গাছের কুফল উল্লেখ করে রাঙ্গামাটি শহরের বাসিন্দা ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আজ থেকে চার-পাঁচ দশক আগেও আমরা যখন ছাত্রী ছিলাম; তখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ফেরার পথে কাউখালীর ঘাগড়ায় কিছু ঝরনা দেখা যেত। ঝিরিতে সারা বছর পানি থাকত। এ সময়ে এসে ওই রাস্তায় সড়কের পাশে কোনো ঝরনা নেই। বর্ষাকাল ছাড়া ঝিরিতেও পানি থাকে না। বিপরীতে দেখা গেল সড়কের পাশে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল সেগুনবাগান। এতে করে পানির উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা ছোট থাকতে বাবা যখন বাগান করেছিলেন তখন তিনি সেগুন গাছ সৃজন করেননি। পরবর্তী সময়ে আমরা বাবার থেকেই জেনেছি সেগুন গাছের বাগানে অন্য কোনো গাছ জন্মায় না। কোনো পোকামাকড় পর্যন্ত গাছের ওপর বসে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে ডানিডার পর বন বিভাগসহ অন্যরা সেগুনবাগানকে উৎসাহিত করেছে। পরে দেখা গেল সেগুন পানি চুষে নেয়ার কারণে মাটিতে পানি থাকে না। মাটি শুষ্ক হয়ে পড়ে। তখন থেকেই সেগুনকে নিরুৎসাহিত করছে বন বিভাগ। কিন্তু শুধু মুখে মুখে নিরুৎসাহিত করলেই হবে না; প্রান্তিক মানুষ যারা গ্রামে থাকে তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলা দরকার। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আলোচনা করা দরকার।’ 

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সেগুন কেবল পানির উৎস নষ্টের জন্যই দায়ী নয়, পাহাড়ে ভূমিক্ষয়ের জন্যও দায়ী। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকায় এবং তেমন পরিচর্যা না লাগায় মানুষ সেগুনবাগানের দিকে ঝুঁকেছে।’ এখন পাহাড়ের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বাঁচাতে সরকারকে সেগুন বাগান সৃজনে নিরুৎসাহিত করতে হবে বলেও মত দেন তিনি। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ডিএফও এবং উপবনসংরক্ষক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য একসময় ব্যাপক হারে সেগুন বাগান সৃজন করেছে। এতে করে দিনে দিনে সেগুনের বাগান বাড়ায় পাহাড়ি ঝিরি-ঝরনাগুলোয় এখন সারা বছর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। সবকিছু বনের অবক্ষয়ের জন্য হয়েছে। পাহাড়ে সেগুন গাছের একক বাগান সৃজন থেকে সরে আসতে হবে। এখন পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোও স্থানীয়ভাবে সেগুনবাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছে।’ 

পার্বত্য চট্টগ্রামে কী পরিমাণ সেগুনবাগান রয়েছে—এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে কী পরিমাণ সেগুনবাগান রয়েছে এটি কঠিন ব্যাপার। তবে বন বিভাগ সেগুন বাগান সৃজনে দীর্ঘদিন ধরেই নিরুৎসাহিত করে আসছে। বন বিভাগের কিছু পুরনো সেগুনবাগান থাকলেও নতুন করে সৃজন বন্ধ রয়েছে। আর পাহাড়ে মূলত ব্যক্তিগতভাবেই অধিক হারে এমন বাগান গড়ে উঠেছে।’ 

ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৮৮৯ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেগুনবাগান তৈরি শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে এ গাছের বাগান করায় এখন পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া প্রাকৃতিক ঝিরি-ঝরনার আশপাশের গাছপালা কেটে ফেলার কারণে মাটিতে পানি ধারণক্ষমতা কমছে। ঝিরি-ঝরনার আশপাশে বনজ গাছ থাকলে এসব গাছের শেকড় দিয়ে মাটি পানি চুষে নেয়। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে মাটির পানি ধারণ সক্ষমতা কমায় সারা বছর পাহাড়ের উৎসগুলোয় পানি পাওয়া যায় না।’ 

আরও