প্রাথমিক শিক্ষা

খেলার মাঠ নেই সাড়ে ১০ হাজার সরকারি বিদ্যালয়ে

শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলা। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিচ্ছেদ্য অংশের মতোই থাকে খেলার মাঠ। খেলাধুলা ছাড়াও সমাবেশ আয়োজন ও শ্রেণীকক্ষের বাইরে পাঠদানের জন্য প্রয়োজন হয় একটি সুন্দর মাঠের। যদিও দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাড়ে ১০ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কোনো খেলার মাঠ নেই।

শিক্ষার্থীদের শারীরিক মানসিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলা। কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিচ্ছেদ্য অংশের মতোই থাকে খেলার মাঠ। খেলাধুলা ছাড়াও সমাবেশ আয়োজন শ্রেণীকক্ষের বাইরে পাঠদানের জন্য প্রয়োজন হয় একটি সুন্দর মাঠের। যদিও দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাড়ে ১০ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কোনো খেলার মাঠ নেই।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, খেলার মাঠ ছাড়া একটি বিদ্যালয় কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। তাই খেলার মাঠ ছাড়া কোনো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন নয়। আর যেসব অনুমোদিত বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় খেলার মাঠ স্থাপন করা প্রয়োজন।

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষের তুলনায় শ্রেণীকক্ষের বাইরের শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হয়। খেলতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সামাজিকীকরণ হয়। তাই বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন অবশ্যই মাঠের বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত। বর্তমানে যেসব বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, সরকারের উচিত সেখানে নতুন মাঠের ব্যবস্থা করা। কারণ খেলার মাঠ ছাড়া একটি বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ হয় না।

দেশের প্রাথমিক শিক্ষার নানা দিক নিয়ে প্রতি বছর অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেন্সাস শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা, শ্রেণীকক্ষ, স্যানিটেশন, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন সেবা সুযোগ-সুবিধার তথ্যাদি তুলে ধরা হয়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এর মধ্যে খেলার মাঠ রয়েছে ৫৪ হাজার ৮২৬টিতে। সে হিসাবে দেশের ১০ হাজার ৭৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই।

বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের সরকারি বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই খেলার মাঠ রয়েছে। হয়তো কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সময় খেলার মাঠ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খেলার মাঠের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

খেলার মাঠের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সিলেট বিভাগের বিদ্যালয়গুলো। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সিলেট বিভাগে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে হাজার ৫৮টি। এর মধ্যে খেলার মাঠ রয়েছে হাজার ২০৩টিতে। সে হিসাবে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩৭ শতাংশ বিদ্যালয়েই খেলার মাঠ নেই। ফলে এসব বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও খেলাধুলায় পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। সিলেট জেলার ১২টি উপজেলার একাধিক পৌর এলাকা উপজেলা সদরের বিদ্যালয়গুলোতে সমস্যা বেশি। সিলেট নগরীর অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা তথ্য জানিয়েছেন। সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, জেলায় মোট হাজার ৪৭৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যালয় রয়েছে বিয়ানীবাজার গোলাপগঞ্জে। সিলেট নগরীসহ সদর উপজেলায় রয়েছে ১২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যার মধ্যে সিলেট নগরীতে পড়েছে ৫৩টি বিদ্যালয়।

সিলেট সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল জলিল তালুকদার জানান, নগরীর ৭০ ভাগ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। এর মধ্যে দরগাহ জালালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধুশহীদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বখতিয়ার বিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দর্শনদেউড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিশোরী মোহন বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঠাটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশির ভাগ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। তিনি বলেন, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকায় অনেক সময় দৈনিক সমাবেশ করাতেও শিক্ষকদের কষ্ট হয়।

অন্যান্য জেলায় খোঁজ নিয়েও একই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়। নওগাঁ জেলায় হাজার ৩৭৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে নওগাঁ সদর উপজেলায় ৩৬টি, আত্রাইয়ে এক, বদলগাছীতে এক, মহাদেবপুরে ৩৬, মান্দায় ৩৬, সাপাহারে ১৫, পোরশায় দুই, নিয়ামতপুরে তিন, পত্নীতলায় ছয় ধামইরহাটে ১৪টিসহ মোট ২১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো খেলার মাঠ নেই।

নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিক মোহাম্মদ ইউসুফ রেজা বলেন, নতুন ভবন সম্প্রসারণ, স্কুল স্থানান্তরসহ নানা কারণে জমিস্বল্পতায় জেলার ২১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে খেলার মাঠ নেই। এর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যালয়ের কিছু জমি মাটি ভরাট করলে খেলার মাঠ তৈরি করা সম্ভব। সাধারণত দানকৃত জমিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো গড়ে তোলা হয়েছিল। শহরাঞ্চলে জমির দাম বেশি হওয়ায় দানকৃত জমির পরিমাণ অনেক কম। তাই সেখানে শুধু একাডেমিক ভবন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। নদী বা পুকুরের কারণে যদি বিদ্যালয়ের কাঠামো ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সেক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের নিয়ম আছে। তবে খেলার মাঠের জন্য জমি অধিগ্রহণের কোনো সুযোগ এখন নেই।

বান্দরবান জেলায় মোট ৪৩৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ২৯৯টি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ রয়েছে। ১৩৬টি বিদ্যালয়ে কোনো খেলার মাঠ নেই। এর মধ্যে কিছু ইউনিয়নে খেলার মাঠের সংকট বেশ প্রকট। এমন এলাকার মধ্যে রয়েছে বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতী ইউনিয়ন। ইউনিয়নের সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচটিতেই কোনো খেলার মাঠ নেই। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো প্রদীপ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, টংকাবতী ইউনিয়নে মাঠ না থাকা পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাঠ করার জায়গা রয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া গেলে ওই পাঁচটি বিদ্যালয়ে মাঠ করতে কোনো অসুবিধা হবে না। এছাড়া বান্দরবান পৌরসভায় বাসস্টেশন, বৌদ্ধ অনাথালয়, হাফেজঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কুহালং ইউনিয়নের চেমী ডলুপাড়া, বটতলী চড়ুইপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও খেলার মাঠ নেই।

কক্সবাজারে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫৮টি। তার মধ্যে প্রায় ২৬৩টি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জেছের আলী জানান, যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোলা মাঠ নেই সেখানে শিক্ষার্থীরা যাবতীয় খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না। ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। যেহেতু মাঠ নেই রকম প্রতিষ্ঠান বেশি, তাই ধীরে ধীরে কমিটি জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নিয়ে মাঠের ব্যবস্থা করা হবে।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের ৭৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৭টির খেলার মাঠ নেই। নগরীর বাইরে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার অধিকাংশ প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ রয়েছে বলে দাবি করেছেন মাধ্যমিক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা। একইভাবে বাগেরহাট জেলায় হাজার ৪১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪১টিতে খেলার মাঠ নেই। রাজশাহী নগরীতে ৬০টি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। ওই অঞ্চলের  নওগাঁয় ৬০টি, নাটোরে ৩৫, বগুড়ায় ২৪, সিরাজগঞ্জে এক এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ২১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ নেই। 

 

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নড়াইল, নওগাঁ, রাজশাহী, বান্দরবান, কক্সবাজার, বাগেরহাট বরিশাল প্রতিনিধি

আরও