দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল, দ্বিতীয় গম। বিভিন্ন দেশ থেকে আগে চাল আমদানি হলেও এখন তা শূন্যের কোটায় নেমেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি দাম সহনীয় রাখতে শুল্ক কমিয়ে আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর পরও দেশের প্রধান খাদ্যশস্যটি আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) জটিলতায় কমছে গম আমদানিও। বাজারে তাই খাদ্যপণ্য দুটির দাম ঊর্ধ্বমুখী।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে মোট গম আমদানি হয়েছিল ৬৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৮০ টন। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে আসে ৭ লাখ ৮৪ হাজার ২৮০ টন ও বেসরকারি পর্যায়ে ৫৮ লাখ ৪৪ হাজার ৩০০ টন। চলতি অর্থবছরে গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে কেবল ১৭ লাখ ৪৮ হাজার টনের মতো। সরকারি পর্যায়ে এ চার মাসে বিশ্ববাজার থেকে গম আনা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৮০ টন, আর বেসরকারি পর্যায়ে ১৫ লাখ ২ হাজার ৫০০ টন। অন্যদিকে এ সময়ে কোনো চালই আমদানি করা হয়নি।
দেশে গমের চাহিদা বছরে ৭০-৭৫ লাখ টন। এর মধ্যে স্বাভাবিক সময়ে ইউক্রেন থেকে মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ আমদানি হলেও বর্তমানে তা কমে ৪০ শতাংশে নেমেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি থেকে বিগত কয়েক বছর গম আমদানি অব্যাহতভাবে বাড়লেও ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে তা কমতে শুরু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউক্রেন থেকে গম আমদানি হয় মোট ১ হাজার ৬৫৮ মিলিয়ন ডলারের, ২০২১-২২ অর্থবছরে হয়েছিল ২ হাজার ৬৫ মিলিয়ন ডলারের। তার আগের অর্থবছর আনা হয়েছিল ১ হাজার ৫৫৮ মিলিয়ন ডলারের গম, ২০১৯-২০ অর্থবছরে যা ছিল ১ হাজার ৪৯১ মিলিয়ন ডলারের।
গম আমদানি কমেছে অন্যান্য উৎস দেশ থেকেও। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে ভারতে গত দুই বছর গমের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। তাই খাদ্যপণ্যটির রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। রফতানিকারক দেশ পাকিস্তানেও গম দুর্নীতি নিয়ে চলছে টানাপড়েন।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারের আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ইউক্রেন থেকে গম ছাড়াও ডাবলি (অ্যাংকর), ভুট্টা, ভুসিসহ বেশকিছু নিত্য খাদ্যপণ্য আমদানি হয়। অনেকে গম আমদানি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ভারতের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে দায়ী করলেও ব্যবসায়ীরা মূলত ডলার সংকট, এলসি খুলতে জটিলতাসহ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটকে সামনে আনছেন। এ কারণে দেশের সার্বিক খাদ্যশস্য মজুদ (চাল ও গম) অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন কম।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৭৩ টন। এর মধ্যে চাল ৯ লাখ ৮ হাজার ৩৭ টন, গম সাড়ে চার লাখের কিছু বেশি ও ধান ৪ হাজার ৬১ টন।
ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করা শীর্ষস্থানীয় এক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগের তুলনায় ডলার সংকট কমলেও এখনো এলসি খুলতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আবার যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণেও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে রাশিয়া থেকেও খাদ্যপণ্যটি আমদানি কমেছে।’
বাজার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের বাজারে ইউক্রেন অঞ্চলের গম লেনদেন হচ্ছে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১ হাজার ৩৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৭০ টাকায়। অন্যদিকে কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা গম লেনদেন হচ্ছে ১ হাজার ৪৭০ থেকে দেড় হাজার টাকায়। কয়েক মাস আগেও গমের দাম মণপ্রতি ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে ছিল। বর্তমানে মানভেদে গমের দাম বেড়েছে মণে প্রায় ১০০ টাকা। চলতি বছরের শুরুতে তা কমতে কমতে ১ হাজার ২৫০ টাকায় নেমে এসেছিল। কিন্তু মজুদ ও আমদানির পরিমাণ কমতে থাকায় গম আগের দামে ফিরে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
চিটাগাং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালক ও খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এ জামান ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. নুরুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও দেশের মোট গমের প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানি হতো ইউক্রেন থেকে। দুই বছরের টানা যুদ্ধের কারণে দেশটি থেকে গম আমদানি কিছুটা কমেছে। তবে একেবারে থেমে যায়নি, দেশীয় চাহিদা ও আমদানিকারকদের সক্ষমতা অনুযায়ী আমদানি অব্যাহত রয়েছে।’
এদিকে সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমনের আবাদ। উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টনে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে চার কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টন আসে আমন মৌসুমে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসলের ফলন কমে যাওয়ায় চালের দাম যেন আর বেড়ে না যায় তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার শুল্ক কমিয়ে আমদানিকে উৎসাহিত ও স্থানীয় মজুদ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। গত ২০ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে।
তাতে অবশ্য খুব বেশি সাড়া দেননি ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্ববাজারেই চালের দাম বেশি। ফলে আমদানীকৃত চাল বর্তমানে দেশের বাজারে যে দাম, তার চেয়েও বেশি দিয়ে কিনতে হবে ক্রেতাদের। তাই লোকসান হওয়ার আশঙ্কা থেকেই সাড়া দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
চালকলের মালিকরাও বলছেন, প্রতিবেশী ভারতে চালের দাম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে শুল্ক কমালেও সেখান থেকে আমদানি করা হলে আমদানিকারকরা কোনো লাভ করতে পারবেন না। তাছাড়া পরিবহন ও অন্যান্য খরচের কারণে আমদানি করা চালের দাম দেশের বাজারের তুলনায় অনেক বেশি হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। ১৭ কোটি মানুষের প্রতিদিনের হিসাব ধরে বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন চাল। শুধু ভাত হিসেবে এ চাল মানুষ গ্রহণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন পোলট্রি ফিড, বীজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চাল ব্যবহার হয় আরো এক কোটি টন। সব মিলিয়ে প্রয়োজন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। কিন্তু গত বছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টন।
সরকারি হিসাবে চাল আমদানি এখন শূন্য। খাদ্য ও দানাদারজাতীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করা হলেও গত দুই বছরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনো চাল আমদানি করা হয়নি বলে খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ মূলত ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানি করে।