মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক ক্ষতির হিসাব এখনো শুরু হয়নি

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৮ জুলাই মেট্রোরেলের নিচে মিরপুর ১০ গোলচত্বরে ফুটওভার ব্রিজে পুলিশ বক্সে আগুন দেয়া হয়। সেই আগুনের মধ্য দিয়েই একটি ট্রেন ছুটে যায়। পরে চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন সন্ধ্যায় মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে চালানো হয় ভাংচুর। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্টেশন দুটির। তবে এখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষতির হিসাব শুরু করেনি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৮ জুলাই মেট্রোরেলের নিচে মিরপুর ১০ গোলচত্বরে ফুটওভার ব্রিজে পুলিশ বক্সে আগুন দেয়া হয়। সেই আগুনের মধ্য দিয়েই একটি ট্রেন ছুটে যায়। পরে চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন সন্ধ্যায় মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে চালানো হয় ভাংচুর। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্টেশন দুটির। তবে এখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষতির হিসাব শুরু করেনি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তদন্ত কমিটি। গতকাল কেবল একটি প্রাথমিক সভা করা হয়েছে। সভায় কমিটির সদস্যদের বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তারা প্রকল্পের পরামর্শক, ঠিকাদার ও ডিএমটিসিএলের কর্মীদের নিয়ে কাজ করবেন।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা স্টেশনের সব পরিকাঠামো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বোঝা যাবে। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং ডিএমটিসিএলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি পুনরায় চালু করতে এক বছরের বেশি সময় লাগতে পারে। আর যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করলে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনগুলো চালু করা সম্ভব।

মেট্রোরেলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং কবে নাগাদ এটি আবার চালু করা যায়, তা নির্ধারণে ২২ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয় ডিএমটিসিএল। মেট্রোরেল লাইন-৬-এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে এ কমিটিকে পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।

ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, সীমিত পরিসরে সরকারি অফিসগুলো চালুর পর গতকাল পর্যন্ত তদন্ত কমিটি তিনটি কার্যদিবস পার করেছে। প্রথম কার্যদিবস অর্থাৎ ২৪ জুলাই কূটনীতিকদের নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন পরিদর্শন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। পরদিন দ্বিতীয় কার্যদিবসে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণে প্রথম দুই কার্যদিবসে তেমন কোনো কাজ করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। গতকাল তৃতীয় কার্যদিবসে মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি পরিদর্শনের পাশাপাশি একটি প্রাথমিক সভা করেছে তদন্ত কমিটি। 

বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান মো. জাকারিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমরা কেবল কাজ শুরু করলাম। আজকেই (গতকাল) প্রথম মিটিং করেছি। কীভাবে কাজগুলো এগিয়ে নেয়া যায়, তার একটা রূপরেখা তৈরি করেছি। বেশ কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা যার যার অংশে পরামর্শক, ঠিকাদার ও ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে তালিকা তৈরি করবে। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণ করতে আমাদের আরো সময় লাগবে।’ 

সরেজমিন গতকাল মিরপুর ১০ এলাকায় দেখা গেছে, মেট্রোরেলের ভায়াডাক্টের (উড়ালপথ) একটি অংশ আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডে কংক্রিটের ভায়াডাক্টের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, ‘‌আমরা ভায়াডাক্টের এ অংশ‌ ভিজুয়ালি ইন্সপেকশন করেছি। আগুনে ভায়াডাক্টের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা তা জানতে টেকনিক্যাল ইন্সপেকশন করতে হবে।’

ক্ষতিগ্রস্ত দুই মেট্রো স্টেশন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‌স্টেশন দুটিতে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। এ কারণে এ মুহূর্তে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারছি না।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মো. জাকারিয়া বলেন, ‘স্টেশন ঘুরে আমরা দেখেছি, কিছু জিনিস মিসিং। আবার কিছু জিনিস উল্টে পড়ে আছে। এসব জিনিস ঠিক রয়েছে কিনা, তা সব ব্যবস্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করলে বোঝা যাবে না।’

অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি পরিদর্শন করা ডিএমটিসিএলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, স্টেশনের কনকোর্স লেভেলে থাকা টিকিট কাটার মেশিন, টিকিট কাটার অফিস, প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ, কম্পিউটারসহ সব যন্ত্রপাতি ও স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্টেশনে বসানো অনেকগুলো সিসি ক্যামেরাও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

স্টেশনসংলগ্ন মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগ ও দুটি মেট্রো স্টেশনে ভাংচুরে ক্ষয়ক্ষতি দেখতে ২০ জুলাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক। মিরপুর ১০ স্টেশন ঘুরে দেখে ওইদিন গণমাধ্যম কর্মীদের ব্রিফিংয়ের সময় তিনি বলেন, ‘‌ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি মেরামত করে পুনরায় চালু করতে এক বছরের মতো সময় লাগতে পারে।’ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য গত শনিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটা এক বছরেও যন্ত্রপাতি এনে সচল করা সম্ভব হবে না।’

যদিও যথাযথভাবে তদন্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্টেশন দুটি পুনরায় চালুর সময়সীমা নিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এমন মন্তব্য করা উচিত নয় বলে মনে করেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমি সরাসরি মেট্রো নির্মাণের সঙ্গে কখনো সম্পৃক্ত হইনি। সুতরাং এ বিষয়ে সঠিকভাবে বলা আমার পক্ষে কঠিন। তবে এতটুকু বুঝি, পুরো স্টেশনের কাজ যদি এখন নতুন করেও করতে হয়, তাহলেও কিন্তু ছয় মাসের বেশি লাগার কথা না।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এ যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‌‌মেট্রো স্টেশনগুলোর অবকাঠামো নির্মাণকাজটি হলো সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ। রড, সিমেন্ট, কংক্রিটের অবকাঠামো তৈরি করতে হয় ধাপে ধাপে। এজন্য সময় দিতে হয়। তবে অবকাঠামো পরিচালনার জন্য যেসব উপরিকাঠামো দরকার হয়, সেগুলোর কাজ খুব বেশি সময়সাপেক্ষ না। সময় যা লাগতে পারে, তা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য। সরকার যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আমদানিতে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনগুলো তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে চালু করে ফেলা সম্ভব।’

বাংলাদেশের ১৬টি স্টেশন নির্মাণের অভিজ্ঞতা আছে উল্লেখ করে ড. সামছুল হক বলেন, ‘‌একটা স্টেশন করতে কী সময় লাগে, সেটা কিন্তু আমাদের জানা। জরুরি সময়ে আমাদের এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দ্রুত মেট্রোরেল ও মেট্রো স্টেশনগুলো চালু করে দেয়া উচিত।’ 

এদিকে মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় রাজধানীবাসীকে ফিরে যেতে হয়েছে আগের সেই ভোগান্তি আর দুর্ভোগের জীবনে। গন্তব্যে পৌঁছতে মিরপুরবাসীকে এখন দেড়-দুই ঘণ্টা বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হতে হচ্ছে। এ পথে নিত্য চলাচল করা বেশ কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর থেকে তারা স্বস্তির যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। পুরনো অভ্যাসে ফিরতে কেউই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। তার সঙ্গে অর্থ ও সময় দুইই বেশি লাগছে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল ও স্টেশনগুলো সংস্কার করে দ্রুতই চালু করার দাবি তাদের। 

উত্তরা-মতিঝিলের মধ্যে গড়ে ওঠা ঢাকার প্রথম এই মেট্রো লাইনটি বর্তমানে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এ কারণে প্রকল্পটি এখনো চলমান। কার্যক্রম চলমান থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত করে ফেলার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বুয়েটের আরেক অধ্যাপক ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের টিকিট কাটার মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে বানানো। কমলাপুরে নতুন একটা স্টেশন হবে। সেখানে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। নিশ্চয়ই যে কোম্পানি মেট্রোরেলের যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে, তাদের কাছে সব নকশা করা আছে। সরকার বা প্রকল্প কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজেই যন্ত্রপাতিগুলো দেশে এনে স্টেশন দুটির মেরামতকাজ শুরু করতে পারে। আমার মনে হয়, ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি মেরামতে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ কম।’ 

ভায়াডাক্ট অংশে কাঠামোগগত কোনো ক্ষতি না হয়ে থাকলে এবং কমিউনিকেশন ব্যবস্থা যদি ঠিক থাকে, সেক্ষেত্রে দুইটা স্টেশনে মেরামতকাজ চলমান রেখেও ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব বলে মনে করেন এ যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেয়ার আগে স্টেশন চালু হতে কতদিন সময় লাগতে পারে, তা বলার সময় আসেনি জানিয়ে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘‌মেট্রোরেল ব্যবস্থা দূরনিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর। ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনগুলোয় প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা জরুরি। পাশাপাশি কংক্রিটের উড়ালপথে আগুনের তাপ লেগে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা, সেটাও ক্ষতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যারা তদন্ত কমিটিতে কাজ করছেন, তারা নিশ্চয়ই এসব বিষয় যাচাই করবেন।’

আরও