দেশে বোরোর পর চালের সবচেয়ে বড় জোগান আসে আমন থেকে। বোরো সেচনির্ভর হলেও আমন পুরোটাই বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। আবাদে তাই খরচ কম লাগে। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ কিংবা জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এ সময়টা সামনে রেখে আমন রোপণের প্রস্তুতি নেন কৃষক। তবে এ বছর জুলাই প্রায় শেষ হতে চললেও বৃষ্টির দেখা নেই। উল্টো তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো এলাকায় সামান্য বৃষ্টি ঝরলেও খুব বেশি উপকারে আসছে না। আবাদি জমিগুলো প্রায় পানিশূন্য। প্রখর রোদে নষ্ট হচ্ছে বীজতলা। নিরুপায় অনেকে বিকল্প ব্যবস্থায় এখন সেচের পানিতে রোপণ করছেন আমনের চারা।
কৃষিবিদরা বলছেন, সাধারণত দেরিতে আবাদ করলে ফসলে রোগবালাই বেশি হওয়ার শঙ্কা থাকে। বেড়ে যায় কীটনাশকের ব্যবহার। এর মধ্যে সেচ খরচ যুক্ত হলে সার্বিকভাবেই বৃষ্টিনির্ভর আমনে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এ মাসের বাকি সময়েও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হলে আমন ধান আবাদ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হবে বলে জানান তারা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জুন থেকে সেপ্টেম্বর—চার মাসে বছরের প্রায় ৭১ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়। জুলাইয়ে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও চলতি মাসের এখন পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৯ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। মাস শেষেও সে হার প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ কম হতে পারে। এর আগে জুনেও প্রায় ১৭ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়েও স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণত জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু গত বছর থেকে জুলাইয়ে বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক কম হচ্ছে। গত বছর অবশ্য অক্টোবর ও নভেম্বরে বৃষ্টি হয়েছিল বেশি। এ বছরও জুলাইয়ে ৫০ শতাংশ কম বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সাময়িকভাবে ফসলের খুব বেশি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। সম্পূরক সেচের মাধ্যমে তা পূরণ করে নেয়া যাবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বৃষ্টি কম হলে তখন ফসলের ক্ষতি হতে পারে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ৫৯ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা। যদিও এ পর্যন্ত ৭ লাখ ৬০ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে রোপা আমন আবাদ হয়েছে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩০০ হেক্টরে আর বোনা আমন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃষ্টি না হওয়ায় অনেকেই এখনো আমন আবাদ করেননি। পানির অভাবে নষ্ট হচ্ছে তাদের বীজতলা। আবার বীজের বয়স বেশি হয়ে গেলে ফলন কমে যায়। পাশাপাশি দেরিতে আবাদ হলে রোগবালাই বেশি হয়। ফলে সার ও কীটনাশকও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে বলে জানান কৃষক। এদিকে নির্ধারিত সময়ে যারা চারা রোপণ করতে পেরেছেন তাদের আবার সেচের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
নওগাঁর তিলকপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের কৃষক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আষাঢ়ের শুরু থেকেই বীজতলাও প্রস্তুত রাখা ছিল। তবে বৃষ্টিপাত না থাকায় এখনো ধান রোপণ করা সম্ভব হয়নি। আশপাশের ডোবা-নালার পানিও শুকিয়ে গেছে। তীব্র তাপপ্রবাহে আমার পুরো বীজতলা এখন নষ্টের পথে। ধান রোপণে যত বিলম্ব হবে, আগামীতে তত বেশি রোগবালাই দেখা দেবে। তাই বাধ্য হয়ে সেচের মাধ্যমে ধান রোপণের উদ্যোগ নিয়েছি বেশ কয়েকজন কৃষক মিলে। এখন বৃষ্টিপাত হোক বা না হোক সেচপাম্প অপারেটরকে বিঘাপ্রতি কমপক্ষে ১ হাজার টাকা দিতে হবে।’
একই জেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের বাঁচাড়ী গ্রামের কৃষক আহসান হাবীব বলেন, ‘এ বছর বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টিপাত নেই, যার প্রভাব পড়েছে ধান রোপণে। তীব্র গরমের কারণে শ্রমিকদের কাজে ধীরগতি এসেছে। হাল খরচ, সেচ খরচ ও শ্রমিক খরচ বেশি পড়ছে। বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা না করে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই সাত বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণ করেছি, যেখানে ২০ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৭ হাজার টাকা খরচ গুনতে হয়েছে।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ছিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৃষ্টিপাত না হলে ধান আবাদ বিলম্ব হতে পারে। এতে ফলন কিছুটা কম হতে পারে। তবে এখন সেচ দিয়ে যদি কৃষক ধান চাষ করেন তাহলে ফলন কম হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। এতে অবশ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তাছাড়া কৃষকদের মধ্যে কেউ আগে আবার কেউ পরে আবাদ করলে পোকামাকড়ের আক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এতে তখন সেচ ও কীটনাশক খরচ দুটোই বেড়ে যাবে।’
সাতক্ষীরা জেলায় এ বছর রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। জেলাটির কৃষকরা জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় আমনের উৎপাদন খরচ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। সদর উপজেলার কুখরালী গ্রামের কৃষক টিপু সুলতান বলেন, ‘বৃষ্টিপাত নেই। মাঝেমধ্যে কিছুটা হলেও তা ফসলের জন্য খুব বেশি কাজে আসছে না। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার বিঘাপ্রতি জমিতে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। সেচ ও কীটনাশকের খরচ ছাড়াও শ্রমিকের খরচ বেড়েছে।’
জেলাটির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আবহাওয়াগত কারণে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা নিয়মিত কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছেন। এরই মধ্যে কৃষকদের লাঙল দিয়ে জমিগুলোয় আগাম চাষ দিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। যেন পরবর্তী সময়ে বৃষ্টি হলে পানি না নেমে যায়। এছাড়া যেসব এলাকায় ভূগর্ভের পানি মিঠা, সেসব এলাকায় তা উত্তোলন করে জমি তৈরি করতে হবে। তবে উৎপাদন কমার শঙ্কা নেই।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেরিতে আমন আবাদ করলে জাতের কারণে ফলন কমে যাওয়ার একটা শঙ্কা থাকবে। মোট ধানের ৪০ ভাগের বেশি আমনে হয়। এখন আমন উৎপাদন কম হলে সমস্যা তৈরি হবে। ভারত চাল রফতানি নিষিদ্ধ করল। আবার শস্য চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় বৈশ্বিকভাবেই খাদ্য নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। কারণ গম আমদানি কমে গেলে মানুষের ভাতের ওপর চাপ বাড়বে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তৈরি হবে সংকট। তাই কৃষককে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা ও সার্বিক সহায়তা বাড়াতে হবে। উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয় সেক্ষেত্রে আগে থেকেই নীতি গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের ধান উৎপাদন অনেক বেড়েছে। গত বছরও খুব ভালো ফলন হয়েছে। এটা ধরে রাখতে হবে।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সাতক্ষীরা প্রতিনিধি গোলাম সারওয়ার ও নওগাঁ প্রতিনিধি আরমান হোসেন রুমন)